বিষয়বস্তুতে চলুন

চন্দ্রবোড়া

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

চন্দ্রবোড়া
Daboia russelii
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ: প্রাণী জগৎ
পর্ব: কর্ডাটা
উপপর্ব: Vertebrata
শ্রেণী: Reptilia
বর্গ: Squamata
উপবর্গ: Serpentes
পরিবার: Viperidae
উপপরিবার: Viperinae
গণ: Daboia
Gray, 1842
প্রজাতি: D. russelii
দ্বিপদী নাম
Daboia russelii
(Shaw & Nodder, 1797)
প্রতিশব্দ
  • Daboia – Gray, 1840 (nomen nudum)
  • Daboia – Gray, 1842
  • Chersophis – Fitzinger, 1843
  • Daboya – Hattori, 1913[১]
চন্দ্রবোড়া সাপের বিষদাঁত

চন্দ্রবোড়া বা উলু বোড়া[২][৩] (বৈজ্ঞানিক নাম: Daboia russelii) ভাইপারিডি পরিবারভুক্ত ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম বিষধর সাপ এবং উপমহাদেশের ভয়ঙ্কর চারটি সাপের একটি। চন্দ্রবোড়া ১৭৯৭ সালে জর্জ শ এবং ফ্রেডেরিক পলিডোর নোডার কর্তৃক বর্ণিত হয় এবং এবং প্যাট্রিক রাসেলের নামে এই সাপের ইংরেজি (Russell's viper) নামকরণ করা হয়, যিনি ১৭৯৬ সালে তার An account of Indian serpents, collected on the coast of Coromandel[৪] বইয়ে চন্দ্রবোড়া সম্পর্কে লিখেছেন।

বর্ণনা[সম্পাদনা]

চন্দ্রবোড়ার দেহ মোটাসোটা, লেজ ছোট ও সরু। প্রাপ্তবয়স্ক সাপের দেহের দৈর্ঘ্য সাধারণত এক মিটার; দেহের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ১.৮ মিটার পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে।[২] এর মাথা চ্যাপ্টা, ত্রিভুজাকার এবং ঘাড় থেকে আলাদা। থুতু ভোঁতা, গোলাকার এবং উত্থিত। নাসারন্ধ্র বড়, যার প্রতিটি একটি বড় ও একক অনুনাসিক স্কেলের মাঝখানে অবস্থিত। অনুনাসিক স্কেলের নীচের প্রান্তটি নাসোরোস্ট্রাল স্কেলে স্পর্শ করে। সুপ্রানসাল স্কেল একটি শক্তিশালী অর্ধচন্দ্রাকার আকৃতি ধারণ করে এবং নাসালকে সামনের দিকে নাসোরোস্ট্রাল স্কেল থেকে আলাদা করে। রোস্ট্রাল স্কেল যেমন বিস্তৃত তেমনি এটি উচ্চ।

চন্দ্রবোড়ার শরীর লেজসহ সর্বোচ্চ ১৬৬ সেমি (৬৫ ইঞ্চি) পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় এবং এশিয়ার মূল ভূখণ্ডে গড় প্রায় ১২০ সেমি (৪৭ ইঞ্চি) পর্যন্ত হয়ে থাকে। দ্বীপে আকৃতি সাধারণত কিছুটা ছোট হয়ে থাকে। এটি বেশিরভাগ ভাইপারের চেয়ে সরু। নিম্নলিখিত মাত্রাগুলি ১৯৩৭ সালে প্রমাণ আকারের প্রাপ্তবয়স্ক চন্দ্রবোড়ার নমুনা হিসাবে রিপোর্ট করা হয়েছিল:

  • মোট দৈর্ঘ্য ১.২৪ মি (৪ ফুট ১ ইঞ্চি)
  • লেজের দৈর্ঘ্য ৪৩০ মিমি (১৭ ইঞ্চি)
  • ঘের ১৫০ মিমি (৬ ইঞ্চি)
  • মাথার প্রস্থ ৫১ মিমি (২ ইঞ্চি)
  • মাথার দৈর্ঘ্য ৫১ মিমি (২ ইঞ্চি)

আঞ্চলিক নাম[সম্পাদনা]


স্বভাব[সম্পাদনা]

চন্দ্রবোড়া সাধারণত ঘাস, ঝোপ, বন, ম্যানগ্রোভ ও ফসলের ক্ষেতে[৬], বিশেষত নিচু জমির ঘাসযুক্ত উন্মুক্ত ও কিছুটা শুষ্ক পরিবেশে বাস করে। স্থলভাগের সাপ হলেও এটিকে পানিতে দ্রুতগতিতে চলতে পারে। ফলে বর্ষাকালে কচুরিপানার সঙ্গে বহুদূর পর্যন্ত ভেসে নিজের স্থানান্তর ঘটাতে পারে।[৬] এরা নিশাচর, এরা খাদ্য হিসেবে ইঁদুর, ছোট পাখি, টিকটিকিব্যাঙ ভক্ষণ করে।[২] বসতবাড়ির আশেপাশে চন্দ্রবোড়ার খাবারের প্রাচুর্যতা বেশি থাকায় খাবারের খোঁজে রাসেলস ভাইপার অনেক সময় লোকালয়ে চলে আসে।

চন্দ্রবোড়া প্রচন্ড আক্রমনাত্মক হয়ে থাকে। পৃথিবীতে প্রতিবছর যত মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়, তার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এই চন্দ্রবোড়ার কামড়ে মারা যায়। এদের বিষদাঁত বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃহৎ। এরা প্রচণ্ড জোরে হিস হিস শব্দ করতে পারে। রাসেলস ভাইপার দিনে ও রাতে উভয় সময়ে কামড়ায়।[৭] অন্য সাপ মানুষকে দংশনের পর সেখান থেকে দ্রুত সরে যায়, কিন্তু রাসেলস ভাইপার ঘটনাস্থল থেকে সরতে চায় না।[৬] অন্য সাপ সাপ শিকারের সময় শিকারকে কামড় দিয়ে সাথে সাথে খেয়ে ফেলে কিন্তু চন্দ্রাবোড়া কামড় দিয়ে ছেড়ে দেয়। প্রচণ্ড বিষের যন্ত্রণায় ইঁদুর যখন তার গর্তের দিকে ছুটে চলে চন্দ্রাবোড়া তার পিছু পিছু গিয়ে সে গর্তে ঢুকে সব ইঁদুরকে খেয়ে ফেলে।[৮][৯]


অন্য সাপ মানুষকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলেও এ সাপটি স্বভাব তার বিপরীত। তাই প্রতিবছরই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ কেবল এ সাপটির কামড়েই প্রাণ হারান। আক্রমণের ক্ষিপ্র গতি ও বিষের তীব্রতার কারণে ‘কিলিংমেশিন’ হিসেবে বদনাম রয়েছে সাপটির।[১০]

বিস্তৃতি[সম্পাদনা]

চন্দ্রবোড়া সাপ পশ্চিমবঙ্গবাংলাদেশের দুর্লভ সাপ। এটি পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ জেলায়, বিশেষ করে নদীয়া, বর্ধমান, উত্তর চব্বিশ পরগনাবাঁকুড়া জেলার গ্রাম অঞ্চলে ভয়ের অন্যতম কারণ। আগে শুধুমাত্র বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে এ সাপ দেখা যেত। যে কারণে এটি বরেন্দ্র অঞ্চলের সাপ বলেই পরিচিত ছিল।[৬] বর্তমানে পদ্মা অববাহিকা ধরে দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জেলায় রাসেলস ভাইপার বিস্তৃত হচ্ছে। বাংলাদেশে রাজশাহী, রাজবাড়ী, ফরিদপুর[১১], কুষ্টিয়া[১২], মানিকগঞ্জ, চাঁদপুর[১৩], হাতিয়া, ভোলাতে চন্দ্রবোড়ার উপস্থিতি পাওয়া দেখা গেছে।[৬]

রাসেল ভাইপার ভারত বাংলাদেশে মহাবিপন্ন প্রাণীর তালিকায় রয়েছে। ২০১৫ সালের লাল তালিকা অনুযায়ী রাসেলস ভাইপার বাংলাদেশে সংকটাপন্ন প্রাণীর তালিকায় রয়েছে।

নদীয়া জেলাসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অংশে এছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, চীনের দক্ষিণাংশ, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, বার্মাইন্দোনেশিয়ায় পাওয়া যায়।[২][৬]

বিষ[সম্পাদনা]

চন্দ্রাবোড়ার বিষ হেমাটোটক্সিক, যার কারণে কামড় দিলে মানুষের মাংস পচে যায়। রাসেলস ভাইপারের বিষ ফুসফুস, কিডনি নষ্ট করে দেওয়ার মতো বিভিন্ন জটিলতা তৈরি করে। রাসেলস ভাইপার সাপের কামড়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ক্ষতস্থান ফুলে যায়।[৭]

অবস্থা[সম্পাদনা]

২০০৯ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষে এটিকে বাংলাদেশে মহাবিপন্ন এবং ও বিশ্বে বিপদমুক্ত বলে বর্ণনা করা হয়েছে।[২] বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।[৩]

ব্যবহার[সম্পাদনা]

লুপাস অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট নামে গর্ভপাতকারী এক রোগ নির্ধারণের পরীক্ষায় (ডাইলিউট রাসেল ভাইপার ভেনম টাইম টেস্ট) চন্দ্রবোড়ার বিষ ব্যবহৃত হয়।

প্রজনন[সম্পাদনা]

সাপ সাধারণত ডিম পাড়ে এবং ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। তবে চন্দ্রবোড়া সাপ ডিম পাড়ার পরিবর্তে সরাসরি বাচ্চা দেয়। ফলে সাপের বাচ্চাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে।[৬] এরা বছরের যে কোনো সময় প্রজনন করে। তবে মে থেকে পরের তিন মাস প্রজনন সবচেয়ে বেশি ঘটে।[৬] একটি স্ত্রী সাপ গর্ভধারণ শেষে ২০ থেকে ৪০টি বাচ্চা দেয়। তবে কোনো কোনো চন্দ্রবোড়া সাপের ৮০টি পর্যন্ত বাচ্চা দেয়ার রেকর্ড আছে।[৮][৯]

আরো পড়ুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. McDiarmid RW, Campbell JA, Touré T. 1999. Snake Species of the World: A Taxonomic and Geographic Reference, vol. 1. Herpetologists' League. 511 pp. আইএসবিএন ১-৮৯৩৭৭৭-০০-৬ (series). আইএসবিএন ১-৮৯৩৭৭৭-০১-৪ (volume).
  2. জিয়া উদ্দিন আহমেদ (সম্পা.), বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ: উভচর প্রাণী ও সরীসৃপ, খণ্ড: ২৫ (ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০০৯), পৃ. ১৮৮-১৮৯।
  3. বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত, জুলাই ১০, ২০১২, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, পৃষ্ঠা-১১৮৫০৮।
  4. Russell, Patrick; Russell, Patrick; Russell, Patrick; Company, East India (১৭৯৬)। An account of Indian serpents, collected on the coast of Coromandel : containing descriptions and drawings of each species, together with experiments and remarks on their several poisons। London: Printed by W. Bulmer and Co. Shakespeare-Press; for G. Nicol। ডিওআই:10.5962/bhl.title.114003 
  5. "Poisonous snakes"www.kerenvis.nic.in 
  6. ইমাম, সাদিয়া মাহ্‌জাবীন (২০২৪-০৬-০৮)। "বিষধর রাসেলস ভাইপারের সংখ্যা বাড়ছে, বদলাচ্ছে স্বাভাবিক চরিত্র"Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৬-০৮ 
  7. প্রতিবেদক, নিজস্ব (২০২৩-০৮-২২)। "রাসেলস ভাইপারের বিষ ফুসফুস, কিডনি নষ্ট করে দিতে পারে"Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৬-০৮ 
  8. "বিষধর সাপের নাম রাসেল ভাইপার"জাগো নিউজ। সংগ্রহের তারিখ ২০ আগস্ট ২০১৯ 
  9. jugantor.com। "চন্দ্রবোড়া | প্রকৃতি ও জীবন | Jugantor"jugantor.com। ২০১৯-১০-০১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-০১ 
  10. "চাঁদপুরে ধরা পড়েছে ভয়ংকর বিষধর 'রাসেল ভাইপার' সাপ"Dhaka Tribune Bangla। ২০১৯-০৮-২০। ২০১৯-১০-০১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-০১ 
  11. প্রতিবেদক, নিজস্ব (২০২৩-০৪-১৩)। "ফরিদপুরে 'রাসেলস ভাইপার' সাপের কামড়ের ৩৬ দিন পর কৃষকের মৃত্যু"Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৬-০৮ 
  12. প্রতিবেদক, নিজস্ব (২০২৩-০৮-১৩)। "গড়াই নদে জেলের জালে বিষধর রাসেলস ভাইপার"Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৬-০৮ 
  13. প্রতিনিধি (২০২৪-০৫-১৯)। "চাঁদপুরে ধানখেতে রাসেলস ভাইপার সাপের উপদ্রব, আতঙ্কে কৃষক"Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৬-০৮