ব্যবহারকারী:DeloarAkram/বিজিপাতা ১২

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

সাইয়েদুল মুরসালীন গ্রন্থটি অধ্যাপক আবদুল খালেক কর্তৃক রচিত বাংলা ভাষার একটি সীরাতগ্রন্থ। এটি ২০০৭ সালে ৩ খন্ডে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে।[১] বইটি মাদ্রাসার উচ্চতর শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বইটির তিনখন্ড মিলিয়ে মোট পৃষ্টা সংখ্যা ১১৭০ এবং ২০১৬ সাল পর্যন্ত মোট দশবার পুনঃমুদ্রণ হয়েছে। বইটির প্রথম ২ খণ্ড প্রকাশ পায় ১৯৫১ সালে, এবং ৩য় খণ্ড প্রকাশ পায় ২০০৭ সালে। বইটি ২০১৬ সাল পর্যন্ত মোট ১০ বার পুনঃমুদ্রন হয়েছে, এরমধ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে ৪ বার প্রকাশ হয়েছে। এটি বাংলা সাহিত্যে কোন আলেম কর্তৃক বৃহৎ ও তথ্যবহুল প্রথম নবী-জীবনচরিত রচনা।

লেখক পরিচিতি[সম্পাদনা]

অধ্যাপক আবদুল খালেক আরবী ও ফার্সী ভাষায় উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন, তিনি ফেনী সরকারী কলেজ, সরকারি ইডেন কলেজ ও প্রেসিডেন্সী কলেজে শিক্ষকতা করেন। তিনি ছতুরা দরবার শরীফের একজন খলিফা ছিলেন। তার লেখনী ও চিন্তাতে মজাদ্দিদ আলফে সানী, শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেস দেলহভী (রহ) ও আহমদ শহীদ বেরলভীর প্রভার প্রবলভাবে লক্ষ্যনীয়। লেখক এই বইয়ের শুরুতেই বই লেখার উদ্দেশ্য বর্ণনা করে লিখেছেন,

বিষয়বস্তু[সম্পাদনা]

লেখক তৎকালীন শোচনীয় সমাজ ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে সেই সময়ের আরব জাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে মহানবী মুহাম্মাদ আগমনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন। এছাড়াও নবী আবির্ভাবের পূর্বে নিজ নিজ ধর্মের বিকৃতি সাধন, তৎকালীন হিন্দুস্তান, চীন ও আরবের ভৌগোলিক অবস্থা ও তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার কথা আলোকপাত করেছেন। লেখক বইটিতে মুহাম্মাদের মাক্কী জীবন, নবুওয়াতের প্রকাশ, শবে মিরাজ, মদিনায় হিজরত, মদীনার জীবন, ইসলামের বিজয়সহ পর্যায়ক্রমে সকল ঘটনার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দিয়েছেন।

গ্রন্থটির প্রুফ রিডার লেখকের মুরিদ কবি ফররুখ আহমদ যত্নসহকারে একাধিকবার এটা পরীক্ষণ করেছেন।[২] বইটি লেখার প্রধান অবলম্বন ও সহায়ক বই ছিলো ইমাম আলী বিন বুরহানুদ্দিন হালাবী’র সীরাত-ই-হালাবী নামক গ্রন্থ। এছাড়াও সীরাতে ইবনে হিশাম, মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া, যাদুল-মা’আদ সহ অনেক বইয়ের সহায়তা নেওয়া হয়েছে।[ক]

গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য থেকে কিছু অংশ নিন্মরূপ[সম্পাদনা]

মূলত এই গ্রন্থে আমরা সাধারণভাবে মশহুর ঘটনাবলীর কিছু বা কোন দিকই বাকি রাখি নাই। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী কে সাজাইতে হইবে রিসালাতের পটভূমিতে। যে সমস্ত ঘটনা ও কার্য প্রমাণিত হইয়া গিয়াছে ঐ সমস্তকে বিচার বা গোপন করিবার অধিকার মানুষের নাই। তাঁহাদের সর্ব কাজ ও আদেশ আল্লাহর আদেশ ও নির্দেশে হইয়া থাকে। ঐ সমস্তই ঈমান ও ইসলামের ভিত্তি; কাজেই সমালোচনার অতীত। তাই কুরআনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ ও অনুকরণ করতে বলা হইয়াছে, সমালোচনা ও বিচার করিয়া সত্যের অপলাপ করিতে নহে। আধুনিক লেখকদের অধিকাংশই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী রিসালাতের পটভূমি হইতে বহু দূরে সরাইয়া ফেলিয়াছেন।


তাঁহারা তাঁহাকে রসূল হিসাবে দেখান নাই দেখাইয়াছেন রিফর্মার সংস্কারক, ভাববাদী অতিমানব হিসাবে। এখানেই সত্যের অপলাপ করা হইয়াছে। রিসালাত প্রমাণ করিবার একমাত্র উপায় হইতেছে মুযিজা। ইহা রিসালাতের মেরুদন্ড। মেরুদন্ড ব্যতীত দেহ যেরূপ দাঁড়াইতে পারে না, মুযিজা ছাড়াও পার্থিবলোকে রিসালাতের সত্যতা প্রমাণিত হইতে পারেনা। নবীগণ আল্লাহ প্রেরিত পুরুষ, তাদের এই দাবির সত্যতা প্রমাণ কল্পে কাফিররা জ্বলন্ত নিদর্শন প্রদর্শনের দাবী করিত। তখন আল্লাহ তা’আলা তাঁহাদিগকে অলৌকিক ঘটনাবলী দ্বারা সাহায্য করিতেন। ঐ সমস্ত ঘটনা দ্বারা একদিকে যেমন অকাট্যভাবে তাঁহাদের দাবির সত্যতা প্রমাণিত হইত, অপরদিকে তেমনি তাওহীদের নিদর্শনও প্রকাশ হইয়া পড়িত। রিসালাতের দাবীর সহিত নবীগণের নিকট হইতে তাওহীদের নিদর্শন রূপে যে সমস্ত অলৌকিক ঘটনা প্রকাশিত হয় তাহাই মুযিজা অপরগুলো নহে। যাঁহারা রিসালাত সম্বন্ধে আলোচনা করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে মুযিজা অস্বীকার করেন, তাহারা যে ওই বিষয়ে সামান্যতম জ্ঞানও রাখেন না ইহা তাহারই পরিচায়ক। যাহারা মুযিজা স্বীকার করেন না, তাহারা রিসালাত স্বীকার করেন না, এবং যারা রিসালাত স্বীকার করেন না, তাহারা সন্দেহাতীতভাবে কাফির। কুরআন, মি’রাজ, চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়া প্রভৃতি মুযিজা। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাস্তিও মুযিজা। যে ব্যক্তি কুরআনের এক অংশ মানে, অপর অংশ মানে না সেও কাফির। আমরা এই গ্রন্থে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মশহুর মুযিজাগুলি সমস্তই লিপিবদ্ধ করিয়াছি। হাদিস ও কোরআনের বর্ণিত অসংখ্য মুযিজার কয়টি তাহারা অস্বীকার করিবেন? …এই গ্রন্থে বহু ঘটনা ও মুযিজা লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং তাহা হাদিস ও সীরাত গ্রন্থ হইতেই করা হইয়াছে। তের শত বৎসর পর অভিনব কিছু ইহাতে স্থান পায় নাই।

আমরা এই গ্রন্থে কোন একজন নির্দিষ্ট লেখকের কোন একটি খামখেয়ালি অভিমত লইয়া অযথা কাগজ অথবা সময় নষ্ট করি নাই; আমরা ঘটনাবলী পাঠকবর্গের সম্মুখে উপস্থিত করিয়াছি। সত্যমিথ্যা আপনাতেই প্রকাশ হইয়া পড়িবে এবং তাহারাও সহজে বিচার করিতে সমর্থ হইবেন। আমরা শরহে-সদর, শককে সদর, মি’রাজ, মুযিজা প্রভৃতি বিষয়ে অপরাপর কৌশলী লেখকদের বিক্ষিপ্ত মূল্যহীন মন্তব্য করিয়া অজ্ঞ ও অশিক্ষিত লোকদিগকে ইসলাম ও আমরা এই গ্রন্থে কোন একজন নির্দিষ্ট লেখকের কোন একটি খামখেয়ালি অভিমত লইয়া অযথা কাগজ অথবা সময় নষ্ট করি নাই; আমরা ঘটনাবলী পাঠকবর্গের সম্মুখে উপস্থিত করিয়াছি। সত্যমিথ্যা আপনাতেই প্রকাশ হইয়া পড়িবে এবং তাহারাও সহজে বিচার করিতে সমর্থ হইবেন। আমরা শরহে-সদর, শককে সদর, মি’রাজ, মুযিজা প্রভৃতি বিষয়ে অপরাপর কৌশলী লেখকদের বিক্ষিপ্ত মূল্যহীন মন্তব্য করিয়া অজ্ঞ ও অশিক্ষিত লোকদিগকে ইসলাম ও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে ক্ষেপাইয়া তুলিতে প্রয়াস পাই নাই; সেইগুলি কুরআন ও হাদীসের পরিপ্রেক্ষিতে এবং মুহাদ্দিস ও ইমামগণের পদাঙ্কানুসরণে সকলের সম্মুখে হাজির করিয়াছি।[৪]

মূল্যায়ন[সম্পাদনা]

অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান ও মোহাম্মাদ আব্দুল হাই মন্তব্য করেন -” মাওলানা আবদুল খালেক এম,এ রচিত “ছাইয়েদুল মুরসালিন” অধুনা প্রকাশিত জীবনী গ্রন্থের মধ্যে উল্লে­খযোগ্য। এ বিরাট গ্রন্থটি রচনায় লেখকের শ্রমশীলতা ও হযরতের প্রতি অকৃত্রিম হৃদয়ানুরাগ লক্ষ করার মতো”। [৫]

বিশিষ্ট সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান তাঁর স্বরচিত নবীজীবনচরিত “মহানবী” শীর্ষক গ্রন্থের ভূমিকায় সাইয়েদুল মুরসালীন সম্পর্কে বলেন -” এই প্রসংগে সর্বশেষ যে গ্রন্থটির কথা উল্লে­খ করব তার নাম হচ্ছে “ছাইয়েদুল মুরলীন”। গ্রন্থটির লেখক মাওলানা আবদুল খালেক। গ্রন্থটি দুই খন্ডে প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে। দুই খন্ড মিলে গ্রন্থটির পৃষ্টা সংখ্যা ৮০৮। বাংলাভাষায় এটিই রাসূলের সর্ববৃহৎ জীবনী। এ পর্যন্ত বাংলাভাষায় প্রকাশিত রাসূলের জীবনী গ্রন্থগুলোর মধ্যে মওলানা আবদুল খালেকের গ্রন্থটি সর্বাপেক্ষা তথ্যবহুল এবং যতটা সম্ভব তিনি রাসূলের জীবনের প্রধান প্রধান সবকটি ঘটনাকেই উল্লে­খ করবার চেষ্টা করেছেন। মুদ্রণ বিভ্রাটের জন্য এবং ভাষার জটিলতার জন্য গ্রন্থটি পাঠে কিছুটা অসুবিধা হলেও তথ্যাদির দিক থেকে এই গ্রন্থটি সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য।”

সব্যসাচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেন- “বাংলা ভাষায় রচিত একটি শ্রেষ্ঠ রসূল-চরিত মওলানা আবদুল খালেকের সাইয়েদুল মুরসালীন।” [৬]

নাসির আল হেলাল সূত্রে মাহদী হাসান বলেন- “বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মরহুম মাওলানা আবদুল খালেক রচিত ‘সাইয়েদুল মুরসালীন’ (দু’খন্ড) বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সংযোজন। ‘মোস্তফা চরিত’,’বিশ্বনবী’ পর্যায়ের গ্রন্থ এটি না হলেও জনপ্রিয়তার দিক থেকে অনেকটা কাছাকাছি। এ গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে। এর পর ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন গ্রন্থটির ৪টি সংস্করণ প্রকাশ করেছে। দু’খন্ডে প্রায় হাজার পৃষ্ঠার এ গ্রন্থটি লেখকের কঠোর পরিশ্রমের ফসল। কাজী নজরুল ইসলাম এবং সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখের সিরাত রচনার অন্যতম উৎস ছিল এই গ্রন্থটি। উল্লে­খ্য যে, এটিই ছিল প্রথম কোন আলেম রচিত সিরাতগ্রন্থ।”[৭]

মুহাইমিনুল ইসলাম মঈন বলেনঃ “মাওলানা আব্দুল খালেক রচনা করেন বাংলাভাষায় সর্ববৃহৎ এবং সর্বাপেক্ষা তথ্যবহুল ৮০৮ পৃষ্ঠার দুই খন্ডের গ্রন্থ “ছাইয়েদুল মুরছালীন”, যা ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয়।”[৮]

মাসিক মাদীনার স¤পাদক, বিষিষ্ট লেখক ও সিরাত গবেষক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান বলেন- “আমার জানামতে বাংলা ভাষায় এ পর্যন্ত প্রকাশিত সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য সীরাত গ্রন্থ মরহুম অধ্যাপক আবদুল খালেক কৃত ‘সাইয়্যেদুল মুরসালীন’ নামক বইটি। এটা দু’খন্ডে সমাপ্ত।…শিবলী নো’মানীর ‘সীরাতুন নবী’, সৈয়দ সুলায়মান নদভীর ‘খুতবাতে মাদরাজ’ সুলায়মান সালমান মনসুরপুরীর ‘রাহমাতুল্লি-ল আলামীন’, মুহাদ্দেস ইদরীস কান্দলভীর ‘সীরাতে মোস্তফা’, মানাজের আহসান গিলানীর ‘রহমাতুল্লিল আলামীন’, আব্দুর রউফ দানাপূরীর ‘আসাহহুস সিয়ার’ প্রভৃতি আমাদের বিবেচনায় সর্বোৎকৃষ্ট। এগুলোর মধ্যে সীরাতুন নবী গ্রন্থের মোট ছয় খন্ডের মধ্যে তিন খন্ডের বাংলা তরজমা প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় মৌলিক রচনার মধ্যে অধ্যাপক আব্দুল খালেকের ‘সাইয়্যেদুল মুরসালীন’, অধ্যাপক শিশির দাসের ‘প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘ ও গোলাম মোস্তফার ‘বিশ্বনবী’ সর্বোৎকৃষ্ট বলে আমার ধারণা।” [৯]

সাইয়েদুল মুরসালীন গ্রন্থে মিলাদুন্নবী প্রসঙ্গ[সম্পাদনা]

তোমাদের কাছে এলেন রসূল, তোমাদেরই একজন

দুঃখ পান তিনি যদি তোমাদের, ঘটে কোন অঘটন

মঙ্গলকামী তিনি তোমাদের, নাই কোনো সংশয়

মুমিনগণের প্রতি স্নেহশীল দয়ার্দ্র অতিশয়

আল কুর’আনে বর্ণিত রসূল (দ) আবির্ভাব বা শুভাগমনের এই প্রেক্ষাপট সাইয়েদুল মুরসালীন গ্রন্থে বিশুদ্ধ দলীল ও অনন্য ভাষা শৈলীর মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে।

মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সময়ের বর্ননা নিমরূপ[সম্পাদনা]

আমিনার মাতৃগর্ভে অনাগত মহামানব সৃষ্টির স্তর পার হইতেছেন। একদা নিশীথে আমিনা স্বপ্নে দেখিলেন যে, কে যেন আসিয়া তাঁহাকে বলিয়া গেলেনঃ তোমার গর্ভে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব অবস্থান করিতেছেন, যখন তিনি ভূমিষ্ঠ হইবেন তখন বলিও, আমি প্রত্যেক হিংসুকের মন্দ হইতে তাঁহাকে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর আশ্রয় সমর্পণ করিতেছি এবং তাঁহার নাম রাখিও মুহাম্মদ। ইঞ্জিলে এবং তাওরাতে তাঁহার নাম আহমদ, যেহেতু আসমান ও জমিনের অধিবাসী কর্তৃক তিনি প্রশংসিত হইবেন।

এই স্বপ্নের কথাই পূর্বে আভাস দেওয়া হইয়াছে। তাঁহার মাতৃগর্ভে অবস্থানকালে আমিনা একটি নূর দেখিতে পাইয়াছিলেন। ইহাতে শামের এলাকায় বুসরা শহরের প্রাসাদ তাঁহার দৃষ্টিপথে পতিত হইয়াছিল। তাঁহাকে গর্ভধারণ করার পর অন্যান্য গর্ভবতী নারীদের মতো তাঁহার অবস্থা হয় নাই।

ভূমিষ্ঠ হইবার কাল নিকটবর্তী হইলে আমিনা পূনঃ একটি নূর দেখিতে পাইয়াছিলেন। এইসময় আরবদেশ দুর্ভিক্ষের করাল কবলে পড়িয়া প্রতিমুহূর্তে হাহাকার করিতেছিল; আরবের আকাশ ক্ষুধিতের আহাজারিতে ভরিয়া গিয়াছিল। তাঁহার বরকতে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির রূপান্তর ঘটিল। আরবের আসমান মেঘে ভরিয়া উঠিল, অজস্র বারিবর্ষণে মরুবক্ষের স্বল্পসংখ্যক নির্জীব বনানী সবুজ আচ্ছাদনে ছায়াশীতল হইয়া উঠিল, দেশের দুঃখ দৈন্য দূর হইয়া গেল। বিভীষিকাময়ী রজনীরশেষে সমস্ত দুনিয়া নবীন আনন্দে দিপ্তীময়ী হইয়া উঠিল। (পৃঃ৩৩)

মিলাদুন্নবী তথা শুভাগমনের সেই মুবারক সময়ের বর্ননা[সম্পাদনা]

‘আমুল ফিল বা হস্তী বৎসরের রবিউল আউয়াল চাঁদের বার তারিখে সোমবার সুবহে সাদেকের সময় মক্কায় সৃষ্টির প্রতীক্ষিত হযরত ধূলির ধরণীতে পদার্পণ করেন । তাঁহার জন্ম আসহাবে ফিল্ম ধ্বংসের এক উক্তি অনুসারে পঞ্চাশ ও অন্য উক্তি অনুসারে পঞ্চান্ন দিন পরে সংঘটিত হয়। মাস, বার ও বৎসর সম্বন্ধে কোন মতভেদ নাই। একটু মতভেদ পরিলক্ষিত হয় তারিখ সম্বন্ধে। কোন কোন বর্ণনায় আট ও নয় তারিখের উল্লেখ রহিয়াছে। তবে এই মত অধিক প্রবল নহে। আমিনা কর্তৃক বর্ণিত হইয়াছে যে, যখন মুহাম্মদ ভূমিষ্ঠ হইলেন তখন তাঁহার সঙ্গে একটি নূর বহির্গত হইল। ঐ নূরে মাশরিক ও মাগরিবের মধ্যবর্তী সমস্ত জিনিসই আলোকিত হইয়া গেল। অন্য হাদীসে এই নূরের বর্ণনা এইরূপে দেওয়া হইয়াছেঃ এই নূরে আমিনা শামের রাজপ্রসাদ দেখিতে পাইয়াছিলেন। অপরাপর আম্বিয়ায়ে কেরামের জননীগণও অনুরূপ নূর দেখিয়া থাকিতেন।

হাদীসে বর্ণিত আছে যে, ফাতিমা বিনতে আব্দুল্লাহ বলিয়াছেনঃ হযরত ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় খানে কা’বাকে নূরে পরিপূর্ণ দেখিতে পাইলাম এবং তারকারাজি জমিনের এত নিকটবর্তী হইয়া গেল যে মনে হইতেছিল তাহারা আমারই উপর ভাঙ্গিয়া পড়িবে। আব্দুর রহমান বিন আওফের মাতা বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত ভূমিষ্ঠ হলে আমার হাতে আসিলেন এবং তাঁহার কান্নার শব্দ হইতে আমি এক ব্যক্তিকে বলিতে শুনিলামঃ রহিমাকাল্লাহ, তোমার উপর আল্লাহর রহমত ধারা বর্ষিত হউক। পূর্ব হইতে পশ্চিম পর্যন্ত আলোকিত হইয়া গেল। আমি রোমের কতিপয় প্রাসাদ দেখিতে পাইলাম। অতঃপর আমি তাঁহাকে তাহার মাতৃস্তনে দুধ পান করাইলাম ও শোয়াইয়া রাখিলাম। কিছুক্ষণ যাইতে না যাইতেই আমাকে অন্ধকার, কম্পন ও ভীতি আছন্ন করিয়া ফেলিল। হযরত আমার দৃষ্টি হইতে গায়েব হইলেন। আমি একজনকে জিজ্ঞাসা করিতে শুনিলামঃ তাহাকে কোথায় লইয়া গিয়াছিলেন? উত্তর প্রদানকারী বলিলঃ মাশরিকে। এই ঘটনার মহিমা আব্দুর রহমান বিন আওফের মাতার হৃদয়ে অক্ষয় হইয়া রহিল। তিনি নবুওয়ত প্রাপ্ত হইলে এই মহীয়সী মহিলা প্রথম ইসলাম গ্রহণকারিণীদের মধ্যে অন্যতমা হইলেন। হাদীসে আছে যে, তিনি মাগরিবের দিকেও নীত হইয়াছিলেন। ভূমিষ্ঠ হইবার কালে পারস্য সম্রাট খসরুর প্রাসাদ কাঁপিয়া উঠিয়াছিল এবং উহার চৌদ্দটি চূড়া ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছিল। ঐ রজনীতে শামের তাবরিয়া এবং পারস্যের ছাওয়া হ্রদ হঠাৎ শুষ্ক হইয়া গিয়াছিল এবং পার্শীদের সহস্র বর্ষের প্রজ্বলিত অগ্নিকুন্ড নির্বাপিত হইয়া গিয়াছিল। ঐ সময়ে আবদুল মুত্তালিব কা’বাগৃহে ছিলেন। তিনি দেখিতে পাইলেন যে, মূর্তিগুলি স্থানচ্যুত হইয়া উপুর হইয়া পড়িয়া গেল এবং কা’বার প্রাচীর হইতে ধ্বনী হইল- মুস্তফা জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন। হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত হইয়াছে যে, হযরতের জন্মদিবসে ভোরবেলায় মক্কায় আগত এক ইয়াহুদী জিজ্ঞাসা করিলঃ কুরাইশগণ! এই রজনীতে কি তোমাদের গৃহে সন্তান জন্মগ্রহণ করিয়াছে? তাঁহারা বলিলঃ আমরা জানি না। সে বলিলঃ অনুসন্ধান করিয়া দেখ, কেননা এই রজনীতে এই উম্মতের নবী জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন। তাহার স্কন্ধদ্বয়ের মধ্যে একটি নিদর্শন থাকিবে। অনুসন্ধান করিয়া দেখা গেল যে, আবদুল্লাহর ঘরে একটি সন্তান জন্মগ্রহণ করিয়াছে। য়াহুদী নবজাত সন্তানটির নিদর্শন দেখিবামাত্র বলিয়া উঠিল- বনি ইসরাইল হইতে নুবূয়ত বিদায় গ্রহণ-করিয়াছে।(পৃঃ৩৪)

মিলাদুন্নবী তথা সেই প্রতীক্ষিত আবির্ভাবে সমগ্র সৃষ্টির আনন্দিত হওয়ার ঘটনা চিত্রিত হয়েছে অনুপম সাহিত্য মাধুর্যে –[সম্পাদনা]

সৃষ্টির প্রাণ পেয়ারা রসুল(সঃ)- এর আবির্ভাব হইল ধূলির ধরণীতে। সৃষ্টির আদি উৎস, সৃষ্টির জ্যোতি শিখা মাটির কোলে নামিয়া আসিল; মহাকাল সময়ের বাগিচার সমস্ত সুরভী কেন্দ্রীভূত হইয়া পূর্ণতায় পরিস্ফুট হইল। যাঁহার আশায় পথ চাহিয়া জিন, ইনসান, ফেরেশতা ও বিশাল বিশ্ব উৎকন্ঠিত হইয়াছিল, তাঁহার আবির্ভাবে সৃষ্টির প্রতি স্তরে যে আনন্দের হিল্লোল উঠিল তাহার তুলনা নাই।

আকাশের অগণিত জ্যোতিষ্ক চোখ ভরিয়া তাঁহার অনুপম তনু দর্শন করিয়া ধন্য হইল। সূর্যালোক তাহার সর্ব দেহ অভিসিঞ্চিত করিয়া গেল। মরু জ্যোৎস্না তাহাকে অভিনন্দন জানাইয়া গেল। যাঁহার জন্য মাখলুকাতের সৃষ্টি, যাঁহার জন্য মানুষ ও ফেরেস্তা, আজ তিনি আসিলেন, তিনি আসিলেন-হর্ষে, আনন্দে, পুলক বেদনায়, সমস্ত সৃষ্টি তাঁহাকে অভিনন্দিত করিল, আলোক আসিয়া তাঁহাকে অভিনন্দন জানাইল, বাতাস আসিয়া তাঁহাকে জড়াইয়া ধরিল, সমস্ত বিশ্বে সেদিন পুলকের কোলাকুলি, আনন্দের বন্যা ধারা। সেদিন ভাষাহীন মুক পশুর কণ্ঠেও ভাষা ফুটিলো; ঊষরতার বক্ষেও অনাগত বনানীর শুভ সংবাদ জাগিয়া উঠিল। পূর্ণতার জ্যোতি লইয়া পূর্ণ মানব ধরায় আবির্ভূত হলেন………(পৃঃ৩৫)

টীকা[সম্পাদনা]

  1. বইটি লিখতে যেসকল বইয়ের সাহায্য নেওয়া হয়েছে, সেটার তালিকা: ১। সীরাত-ই-হালাবী - ইমাম আলী বিন বুরহানুদ্দিন হালাবী ২। সীরাতে ইবনে হিশাম - আবু মুহাম্মদ আব্দুল মালিক বিন হিশাম ৩। জাদুল-মা’আদ - ইমাম আবু আব্দুল্লাহ বিন কাজয়েম জাওমী ৪। রাওজুল উনফ - ইমাম সোহাইলী ৫। খাসাযয়েসে কুবরা - ইমাম জালালউদ্দীন সুয়ূতী ৬। সীরাতুন্নবী - শিবলী নোমানী ও সুলায়মান নদভি ৭। আসাহচ্ছিয়ার - মাওলানা আব্দুর রউফ দানাপুরী ৮। হজরতে মোহাম্মদ (সা.) - মোহাম্মদ হোসাইন হাইকেল (মিশর) ৯। শাযারাতুল কওম - শেখ আকবর ইমাম মহীউদ্দিন ইবনুল আরাবী ১০। মাকতুবাত - মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী ১১। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া - ইমাম আহমদ ১২। মিশকাতুল মাসাবীহ ও অপরাপর হাদিস গ্রন্থ ১৩। বয়ানুল কুরআন, তাফসীরে আজিজি ও অন্যান্য তাফসীর

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "সাইয়েদুল মুরসালীন : অধ্যাপক আবদুল খালেক"Mozlish (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২২-১০-০৩। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৫-০৪ 
  2. খালেক এমএ, আব্দুল (১৯৫১)। সাইয়েদুল মুরসালীন। বিবাড়িয়া: ছতুরা দরবার শরীফ। পৃষ্ঠা ১৮ – ২২। 

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]