সুধীরচন্দ্র কর

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

সুধীরচন্দ্র কর (১৯০৬ — ১৯৭৭) ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খাস মুন্সী এবং লিপিকার।[১] কবিগুরু শেষের দিনগুলিতে, যখন অসুস্থতার কারণে স্বহস্তে লিখতে পারতেন না, তখন কবি মুখে মুখে বলে যেতেন আর সুধীরচন্দ্র লিপিবদ্ধ করতেন এবং সযতনে সেগুলি প্রবাসী পত্রিকায় পাঠানো বা প্রকাশের ব্যবস্থা করতেন। [২] অভিনেতা, গায়ক, সুরকার ও গদ্য শিল্পী হিসাবেও পরিচিতি ছিল তার। [৩]

সুধীরচন্দ্রের জন্ম ব্রিটিশ ভারতের পূর্ব বাংলায় অধুনা বাংলাদেশে। সেকারণে, তিনি "সুধীর বাঙাল" (রবীন্দ্রনাথও তাকে ‘বাঙাল সুধীর’ বলতেন) নামেও সুপরিচিত ছিলেন। শিক্ষাজীবনে তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি নাট্য ও সঙ্গীতচর্চা করতেন, কবিতা ও নাটক রচনা করতেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কর্মসূত্রে শান্তিনিকেতনে আসেন গ্রন্থাগারের কাজে। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ সুধীরচন্দ্রের ব্যাপারে সবকিছু অবগত হন এবং ছয় মাসের মধ্যেই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ সহকারী হয়ে যান। রবীন্দ্রনাথের লেখালেখির পরিমার্জন, প্রুফ সংশোধনসহ বিভিন্ন কাজের তদারকি করতেন। কবি হয়তো কোন লেখা মনপূতঃ হয়নি বলে ফেলে দিয়েছেন, সুধীরচন্দ্র তা কুড়িয়ে সযতনে রেখে দিয়েছেন। কবি তা' নিয়ে ছড়া-কবিতায় উল্লেখ করেছেন এভাবে-

“লেখার যত আবর্জনা, জেনে রেখো সকলে, সমস্ত রয় কর মশায়ের দখলে।”

কবিও প্রকৃতপক্ষে তার উপর নির্ভর করতেন বিভিন্ন কাজে। শান্তিনিকেতনে আসার আগে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে কবির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল কুমিল্লার এক অনুষ্ঠানে। শান্তিনিকেতনে এসে রবীন্দ্র-পরিচয় সভার সংগঠক, সংস্কার সমিতির গ্রামসেবকের কাজ ছাড়াও সুধীরচন্দ্র অমান্য আন্দোলনের সমর্থনে গ্রামে গ্রামে প্রচার করতেন। গ্রেফতার হয়ে জেলেও গেছেন। সরকারের নজরে পড়ে যাওয়ার ভয় অগ্রাহ্য করে কবি সুধীরচন্দ্রকে ফিরিয়ে এনেছেন কাজে।[১]

রবীন্দ্ররচনার ভাণ্ডারী হিসাবে সুধীরচন্দ্রের প্রধান অবদান ছিল - গীতবিতান-এর প্রথম সংস্করণ প্রকাশের সময় (১৯৩১-৩২), গান রচনার কাল ও গানের আদ্যক্ষর অনুযায়ী সূচি নির্মাণ।[১] ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে কবিগুরুর নামে আসা সমস্ত চিঠিপত্র তিনি ও কবিগুরুর ব্যক্তিগত সচিব অনিলকুমার চন্দ সংরক্ষণ করেছেন এবং সেগুলি শান্তিনিকেতনে “পাগলা ফাইল” নামে সংরক্ষিত হয়েছে।[৪] সঙ্গীত ভবনের অধ্যক্ষ শৈলজারঞ্জন মজুমদার ন্যায় সুধীরচন্দ্রও রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে জোর করে গান লিখিয়ে নিতেন। কবি ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে এসম্পর্ক লিখেছেন -

”বাঙাল যখন আসে মোর গৃহদ্বারে,

নূতন লেখার দাবি লয়ে বারে বারে

আমি তারে হেঁকে বলি সরোষ গলায়

শেষ দাঁড়ি টানিয়াছি কাব্যের কলায়...’।

সুধীরচন্দ্র তাতে মোটেই হতাশ হতেন না, নতুন লেখা অবশ্যই পেয়ে যেতেন কবির কাছ থেকে। এভাবেই “বাঙাল সুধীর” বারো বৎসরের অধিক সময় “খাসমুন্সী” হিসাবে কাটিয়েছেন কবিসঙ্গে। [৫]

দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, অনাদিকুমার দস্তিদার প্রমুখ রবীন্দ্র-স্বরলিপিকারদের মত সুধীরচন্দ্র বেশ কিছু রবীন্দ্র গানের স্বরলিপি রচনা করেছেন। উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্র সংগীত গুলি হল —

  • তোমার কাছে এ বর মাগি মরণ হতে যে জাগি
  • 'নাই বা ডাকো রইব তোমার দ্বারে
  • দুঃখ যদি না পাবে তো
  • ও নিঠুর আরো কি বাণ তোমার তূণে আছে
  • আমি হৃদয়েতে পথ কেটেছি সেথায় চরণ পড়ে
  • যেতে যেতে চায় না যেতে
  • সকল জনম ভরে ও মোর দরদিয়া
  • বিশ্ব জোড়া ফাঁদ পেতেছ
  • না বাঁচাবে আমায় যদি মারবে কেন তবে

সুরকার সুধীরচন্দ্র সুলেখকও ছিলেন। তবে তিনি তার রচনায় নিজেকে শান্তিনিকেতনের 'একজন কর্মী' ও রবীন্দ্রনাথের 'রচনা-রক্ষক' হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকীর্তি হল - ‘জনগণের রবীন্দ্রনাথ’ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্যের দিনগুলির স্মৃতিচারণে লেখা গ্রন্থ- ‘কবি-কথা’। অন্যান্য গ্রন্থ গুলি হল —

  • রবীন্দ্র আলোকে রবীন্দ্র পরিচয়
  • জনগণমন অধিনায়ক
  • শান্তিনিকেতন প্রসঙ্গ (সাধনা করের সঙ্গে)
  • শান্তিনিকেতনের শিক্ষা ও সাধনা
  • সুরধনী
  • চিত্রভানু

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. সায়ন্তন মজুমদার। রবিলিপিকর সুধীরচন্দ্র কর। বীরুৎজাতীয়, কলকাতা। 
  2. "তাঁর শেষ দিনগুলি"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৬-১৪ 
  3. "রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যই তাঁর পরম প্রাপ্তি"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৬-১৪ 
  4. "রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে যত কাণ্ড"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৬-১৫ 
  5. "কলকাতার কড়চা-কবিকথা"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৬-১৫