বিষয়বস্তুতে চলুন

আলাপ:বাঁদনা পরব

পাতাটির বিষয়বস্তু অন্যান্য ভাষায় নেই।
আলোচনা যোগ করুন
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
       বাঁদনা পরব(BADNA_PARAB)


আশ্বিনের শুক্লা জ্যোৎস্না যখন কাঁসাই, শিলাই, সবন্নাখার চড়ায় ঢেউ খেলে যায়। বর্ধিষ্ণু পরিবারের দেওয়ালে আটকানো দূরদর্শনের পর্দায় বিজয়া নিশীথে ঝলসে ওঠে বাঙালী বধূদের মন কেমন করা মুখগুলি। যখন জিহুড় মাসের ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির হিসেব মেলাতে বসে শহুরে কর্তারা- পলাশের দেশে তখন সম্পূর্ণ উলটো চিত্র। পূজাবসানের হা-হুতাশ নেই, আছে আবাহনের উচ্ছ্বাস। মরদরা মুক্ত জীবনানন্দ! বিটিছানাদের মনে তখন লালমাটি, নীলবড়ি, ধবমাটি সম্পৃক্ত নন্দনতত্ত্বের ছোঁয়া। মা'র আটপৌরে শাড়ির আঁচল ধরে সোনাসোনা মুখ করে চুন্নুমুন্নুরা আধভাঙা তেলের টিনে তুলে দেয় আগডুম বাগডুম বাদ্য। কাঠের ঢেঁকির ছন্দময় প্রতিটা বোল যেন বলে যায়- অহল্যাভূমির বুকে বাঁদনা আসন্ন।

করমতীর্থে নাচখেলের ইতি ঘটলেই জঙ্গলমহলে দিন গোণা শুরু হয়। সিংভূম, মানভূম তথা অধুনা সীমান্তবাংলার শালপলাশ ঘেরা ভূখন্ডের গরীবগুর্বো মানুষের প্রাণের উৎসব বাঁদনার, শব্দগত উৎপত্তি সম্পর্কে নানা পণ্ডিতের নানা মত। কেউ বলেন 'বন্দনা' থেকে 'বাঁদনা', অন্যপক্ষের মতে- এই পরবের প্রাণ হল গোরু খুঁটা অর্থাৎ গোরুকে খুঁটিতে বেঁধে গানবাজনা সহযোগে উত্তেজিত করা। এই গোরু 'বাঁধনা' থেকেই 'বাঁদনা' শব্দের আগমন ঘটেছে। তা, যাই হোক- বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের টোটেমিক কুড়মি জাতির অন্যতম প্রধান উৎসব হল বাঁদনা, এই নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কুড়মি জাতির সংখ্যাধিক্য ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের কারণেই এই পরব ক্রমে বিভিন্ন হিতমিতান জাতির মধ্যে সঞ্চালিত হয়েছে। তাই বাঁদনা আজ একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সমষ্টির মধ্যে।

অনুর্বর জমিতে যখন আঘনের হাতছানি, হৈমন্তী যামিনী- শিশিরধোয়া শালীনতা এঁকে দিচ্ছে দুর্বাঘাসের মাথায় মাথায়! অ্যানিমিস্টিক আদিবাসী কুড়মিদের ঘরেও তখন স্বচ্ছতার অভিযান। মাটির ঘরের দেওয়ালে পড়ে- প্রথমে খড় মাটি, পরে গোবর, ছঁছ মাটির ত্রিস্তরীয় প্রলেপ। ইস্ত্রির মতো পাথরের নোড়া দিয়ে ঘষে ঘষে মেঝেকে তেল চিকচিকে মসৃণ করার শৈল্পিক প্রচেষ্টায় ব্রতী হয় মাটির মানবীরা। পুঁচকি পুঁচকি মেয়েরাও আল পথ বেয়ে টুপা, ডালা ভর্তি মাটি মাথায় করে এনে জমা করে বাড়ির উঠোনে। পুঁচকির মা'দের নিপুণ হস্তচালনায় দেওয়াল গাত্রে চিত্রিত হয়- ৮১ গোষ্ঠীর বিভিন্ন টোটেম। স্বশিক্ষিত শিল্পীদের এই অপূর্ব শিল্প সুষমা দেখে বিস্মায়াপন্ন হতে হয়!

চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী কার্তিক অমাবস্যার পূর্বদিন থেকে মোট পাঁচ দিন ব্যাপী বাঁদনার মহকে ম-ম করে শিখরভূমের বাতাস। অবশ্য, পরবের শুভ সূচনা হয় তারও কয়েকদিন আগে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক শাসন ব্যবস্থার চূড়ামণি গাঁয়ের মাহতো, লায়া, দেহরি কিম্বা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি নির্ধারণ করেন- ৩, ৫, ৭ বা ৯, এই ক'দিন ধরে গবাদি পশুর শিংএ গৃহস্বামী তেল মাখাবে! এরা মাছের তেলে মাছ ভাজা তত্ত্বের ধারক বাহক নয়- তাই গোরুর শিংএ কচড়া তেল মাখানোয় বিশ্বাসী। কারণ কচড়া তেল প্রস্তুত করতে গোধনকে খাটাতে হয় না যে! কচড়া তেলের অপ্রতুলতার কারণে বর্তমানে সরষে তেলে ব্যবহৃত হলেও- কচড়া তেলের ধারণাটি যে কৃষিজীবী মানুষদের গবাদি পশুর প্রতি প্রেমের দ্যোতক, তা বলাই বাহুল্য!

এভাবেই ঋঝে রঙ্গে গোবর নিকানো উঠোনে হাজির হয়- ঘাওয়া, অমাবস্যা, গরইয়া, বুঢ়ী বাঁদনা ও গুঁড়ি বাঁদনার উৎসবমুখর দিনগুলি। পঞ্চদিবসে তেল দেওয়া, গঠ পূজা, জাগান, গহাইল পূজা, চুমান, কাঁচি জিওরি, চউক পুরা, নিমছান, গোরু খুঁটা, কাঁটা কাঢ়হা প্রভৃতি ১১ টি প্রধান পর্ব সহ মোট ১৬ টি নেগাচারের মাধ্যমে উদযাপিত হয় বাঁদনা পরব।

● কাঁচি দুয়ারি : অমাবস্যার ঠিক আগের দিনটিই হল ঘাওয়া। এদিন দিগন্তরেখায় সূর্য মুখ লুকোলেই শালপাতায় চালগুঁড়োর পিণ্ড বানিয়ে, তাতে পরিমাণ মতো বিশুদ্ধ গাওয়া ঘি ঢেলে- তারপর কাপাস তুলোর সলতে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। দুয়ার, আঙিনা, নির্মীয়মান খামার সর্বত্র টিমটিম করে জ্বলে ঘৃতপুষ্ট অগ্নিশিখা। এর পোষাকী নাম কাঁচি দুয়ারি বা কাঁচি জিওরি। ঘরে দুয়ারে এহেন মঙ্গলদীপ জ্বেলে গাওয়া হয় সহরই গীত- "ভালা অহিরে.... কণ দিয়া বরয়ে সাঁঝেকো বেরিয়ারে, বাবু হো.... কণ দিয়া বরত বিহান, কণ দিয়া বরয়ে আম মাড়য়াঁই, সেই দিয়া বরত বিহান।"

● গঠপূজা: অমাবস্যার দিন(১ম দিন) গাঁয়ের লায়া বা দেহরি দিনভর নির্জলা উপোস করে গ্রাম শেষের রাঙামাটির পথে ৯ টি ঘর কেটে কপিলাসন্তানদের মঙ্গল কামনায় গঠ পূজা করেন, গঠ অর্থাৎ গোরুর পাল।পূজাস্থলে রেখে দেওয়া হয় দেশী মুরগীর ডিম অথবা তার প্রতীক হিসেবে চাল গুঁড়োর মণ্ড। যার বলদের পদাঘাতে সেই ডিম ভাঙে, সেই খামিদকে ভাগ্যবান বলে মনে করা হয়। ভাগ্যবান খামিদ সব গোপালকদের পা ধুইয়ে আদরযত্ন করে 'গঠ ডেঙ্ঘা' নামক নেগটি সুসম্পন্ন করেন। গটপূজার একটি অহিরা গিত হল-

"অহিরে- আঝু যে হেকেইক ভালা গঠঅ পুজাক দিন গউ- গেইআ ধনি ঘুরতউ বাথান গেইআ জে ধনি ত ঘুরতউ বাথান গউ আঝু হেকেইক গঠঅ পুজাক দিন।

অহিরে-নেহি অহিরাঞ সুনইএ নেহি অহিরাঞ মানই গউ লেইএ জাহ জড়নিকর বন গউ সভে গেইআ ডহরে উজাই। অহিরে-একা কসা গেলি গেইআ দিঅ কসা গেলি গউ তিনি কসে জড়নিকর বন। সভে জে গেইআ ভালা বনে ঢুকি গেলা গউ গপইআ ধনি ঘাঁসে ঝুঁঝুকাই।

অহিরে-সবেঝে গেইয়আ ভালা বনেহি চরইএ গউ গউঅহিরা ত খেলই চলি ডাঁগ আর না অহিরা ত খেলই চইলি ডাঁগ গউ বাঘাঞ ভালা করল নজর ।"

● জাগরণ: এরপর অমানিশা নামলেই- নিকষ অন্ধকারে(অমাবস্যার রাতে) ভারতের নানা প্রান্তে যখন দীপান্বিতার আলোকসজ্জা আর কালীপূজা, ঝাড়খণ্ডী সংস্কৃতিপুষ্ট বাংলার পশ্চিম প্রান্তে কিন্তু সেসবের বালাই নেই। তবে প্রতিটা গোয়ালঘরে জ্বলে শুভঙ্করী মৃৎপ্রদীপ। গোরু, কাড়ার তেল চকচকে শিংগুলি মায়াবী হয়ে ওঠে পিদিমের আলোয়। ঢোল, ঢমসা, মাদৈলের বজ্র নির্ঘোষে গোসন্তানদের অভিনন্দন জানায় বন্দনাকারীরা। এদের প্রচলিত নাম ঝাঁগড়। একজন ঝাঁঁগড়িয়া কানে হাত দিয়ে অহিরা গীত ধরে, অনুবৃত্তি করে বাকিরা- "ভালা অহিরে.... জাগহ চনদা, জাগহ সুরুজরে, বাবু হো.... জাগহ গহালিকের গেইয়া, জাগরণ পরতি ফল দেবে বুঢ়াবাপে, পাঁচ পুতা দস ধেনু গেইয়া।" - জাগান শেষ হলে গৃহস্বামী মনানন্দে ঝাঁগড় দলের হাতে তুলে দেয় দু'পাঁচ টাকা, দু'এক সের চাল। গিন্নী ঝুলি ভরে পিঠালাঠা (খাপরা পিঠা,ছিলকা পিঠা,গূড় পিঠা,মশলা পিঠা ), মুড়িচিড়া দিয়ে ঝাঁগড় বিদায় করে।

● গরইয়া: বাঁদনার ২য় দিনে পানিয়া লতা মাড়াই করে নিষ্কাশিত করা হয় সান্দ্র দেহরস। তাতে আতপ লালের গুঁড়ি মিশিয়ে নতুন মাটির তকতকে উঠোনে আঁকা হয় চউক। চউক পুরা অঙ্গনে সাজিয়ে রাখা হয় হাল, জোয়াল। কর্তা পুণ্যতোয়া পুষ্করিণী থেকে তুলে আনে ডাঁটাসহ শালুক ফুল। কর্ত্রী চালগুঁড়ো দুধে গুলে, নবনির্মিত মাটির চুলোয় ঘিয়ে ছেঁকে তৈরি করে পিঠা। দুধ, গুড়, আতপচাল, পিঠে উপাচারে- গোয়ালঘরে পূজিত হন গরাম, ধরম, বসুমাতা, গঁসাইরাই, নাজি লিলঅউরি, গাই গরইয়া, মৈস গরিয়া, ডিনি ঠাকুরাইন ও বড়োপাহাড়। গরাম ঠাকুরের উদ্দেশ্যে লাল মোরগ ও ধরম ঠাকুরের উদ্দেশ্যে সাদা মোরগ উৎসর্গের মাধ্যমে সমাপন ঘটে গরইয়ার।

●গরুখুঁটা : এটি ৩য় দিনে হয়। কৃষিজীবী লোকেদের কাছে বলদ পুত্রস্বরূপ। গৃহস্থের শ্রীবৃদ্ধির জন্য বছরভর অক্লান্ত খাটে এরাও। তাই বাঁদনার এই দিনে প্রহারের বদলে ধান্য নির্মিত হারে বিভূষিত করা হয় কপিলাসন্তানদের। জোয়ালক্ষত কাঁধে পরম মমতায় লাগিয়ে দেওয়া হয় তেল। কাঁচাপাকা ধানের শীষ ছিঁড়ে তৈরি করা হয় অনিন্দ্যসুন্দর মুকুট ও সিঁথলী, পরানো হয় গোরুর মাথায় আর কপালে। স্নেহার্দ্র চিত্তে গবাদি পশুদের পদপঙ্কজ ধুইয়ে দেয় গৃহিণীরা। লাল, নীল রঙে সাজিয়ে দেওয়া হয় গরুর দেহ, কেউ বা এঁকে দেয় নিজের গোষ্ঠীর টোটেম! বাড়ির মহিলারা নতুন শাড়ি পরে,ছেলেরা এক খিলি পান মুখে পুরে, নতুন কুলোয় নৈবেদ্য সাজিয়ে ভক্তিভরে চুমান বাঁদান করে। এই পর্যায়ের নেগাচারের সাথে সাথে হড়দের আত্মপরিচিতির প্রসঙ্গটিও প্রতিভাত হয়েছে নিম্নোক্ত অহিরাটিতে- "ভালা, অহিরে.... কুড়ুমা পাহাড়ে কেরি, কঁচি কঁচি ঘাসঅরে, বাবু হো.... হড়প্পা নগরেক ডমিন, সরু সরু সরু বাঁসিয়াই সুপতি বানাঅ হ, সেই সুপে গেইয়ানি চুমাই।" অশুভ শক্তির হাত থেকে গোধনকে বাঁচাতে বাড়ির রমণীরা একটি মৃৎপাত্রে আগুন সহ ধুনা নিয়ে গিয়ে গাঁয়ের শেষে নেগাচার অনুযায়ী পায়ের আঘাতে সেটি ভেঙে ফেলে। মৃৎপাত্রটি ভেঙে ফেলার রীতিটির পরিভাষাগত নাম 'নিমছান'।

এদিনই শেষ বিকেলে গাঁয়ের প্রান্তে সুপরিসর মাঠে সবাই ভিড় জমায়। শক্ত খুঁটিতে বাঁধা হয় সুপুষ্ট, বলবান, তেজী বলদ আর দুর্দম, উদ্দাম কাড়া। ঝাঁগড়ের তারস্বরে অহিরা আর অভ্রভেদী বাজনা শুনে রোষে ফুলে ওঠে বরদা, কাড়া! সাহসী পুরুষরা বাঁধাড় কাড়ার সামনে মৃত পশুর চামড়া ধরে! সমবেত কুলকুলি শুনে উন্মত্তের মতো ফুঁসে ওঠে খুঁটানো কাড়া খুঁটিকে ঘিরে চরকির মতো পাক খায়, কখনো প্রবল বিক্রমে গুঁতো মারে চর্মখণ্ডে! নিজের আপাত শান্ত বলদটিকে উত্তেজিত করতে, কেউ কেউ কানে আঙুল চেপে অহিরা হাঁকায়- "ভালা অহিরে.... সব দিন যে চরাই ভালা, বনে জঙ্গলে রে, বাবু হো.... আজি তর দেখিব মর্দানী, আজকার রণে ভালা, জিতি যদি যাবে রে, বাবু হো.... চারিপায়ে নূপুর ছাহাবো।" আপাত দৃষ্টিতে বলদ খুঁটার মধ্যে কৃষিকর্মে ক্লান্ত, প্রান্তভূমির ব্রাত্যজনদের চিত্তবিনোদনের দিকটি পরিলক্ষিত হলেও, অনেকের মতে এটি এই অঞ্চলের আদিম অধিবাসীদের জীবন সংগ্রামের ইতিহাসের চলমান দলিল। অরণ্য বেষ্টিত এই ভূখণ্ডটি ছিল শ্বাপদসঙ্কুল। প্রায়ই অযোধ্যা, দলমা থেকে আগত হানাদার জন্তুর কবলে পড়তে হতো এদের। কাজেই অস্তিত্বের জন্য সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করে নিজেরা। অনুরূপ কসরত শিক্ষা দেওয়া হয় গৃহপালিত পশুদেরও। একবিংশ শতাব্দীর গোরুখুঁটা সেই কসরত শিক্ষারই একটি পরিবর্তিত রূপ। প্রচলিত অহিরাতেও এমন ইঙ্গিত মেলে- "ভালা অহিরে.... কপিলাকর পুতা ভালা, সিসু বালকঅরে, বাবু হো.... মহিষাকর পুতারে ডামাল, বাঘেকর পুতা ভালা, অতি বলীয়ান হে, রগড়ি ধরতে ধেনু গাই রে...."

●বুড়ি বাঁদনা: বৃষ যদি হয় বল ও বীর্যের প্রতীক, তবে গাভী হল কল্যাণী, শুভশক্তির প্রতীক। বুঢ়ী বাঁদনা গৃহপালিত বলদের মর্দানী দেখানোর তিথি। কোনো কোনো অঞ্চলে গুঁড়ি বাঁদনার দিনে সেই মর্দানী ক্ষেত্রে বন্ধ্যা গাভীকে বেঁধে ঘোরানোর রেওয়াজ প্রচলিত। এর ফলে গাভী প্রজননে সক্ষম হবে- এই লোকবিশ্বাস থেকে গাইখুঁটা! এদিন বছরভর দুধ দেওয়া ধেনুদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনেরও দিন। গাভীদের অভিমান ভাঙানো, কৃতজ্ঞতা জারিত অহিরা ধ্বনিত হত পথে প্রান্তরে- "ভালা অহিরে.... আশ্বিন যাইতে কার্তিক সামাতে রে, বাবু হো.... কাঁদে ত শিরমণি গাই হে, না কাঁদ, না কাঁদ, সুরধনী গেয়া হো, মাখাব শিং ভরি তেল রে..."

গ্রাম্য কবিদের রচিত, লোকমুখে প্রচলিত অহিরাগুলির মূলভাষা কুড়মালি। পুরুলিয়ার উত্তরাংশে, পশ্চিম মেদিনীপুর, ছোটনাগপুরের হাজারিবাগ, রাঁচীর পাঁচ পরগণা অঞ্চলে প্রচলিত অহিরাতে কখনো ফুটে ওঠে সরল কথায় মানব জীবনের জটিল জীবনদর্শন, - "ভালা অহিরে... মানুষ জীবন ভালা, ঝিঞাফুলের কলি রে, বাবু হো..... সাঁঝে ফুটে বিহানে মলিনঅ রে।" আবার কখনো উৎসারিত হয় নিজেদের সাংস্কৃতিক সঞ্জাত আবেগ- "ভালা অহিরে... দেসে দেসে ঘুরল ভালা, কাঁহু নি পাউঅল গমি, বাবু হো.... কলকলিয়া গীত ঝুমৈরের চাস! এহ মানভূমেক মাটি যখন হামি পাউঅল, দাঁপি ঋঝে উড়ি গেল ভুখ পিয়াস।"

ঘাওয়ার দিন পাঁচেক পর- পশ্চিম বাঁকুড়া, উত্তর পশ্চিম মেদিনীপুর, ধলভূম, মানভূম, সাঁওতাল পরগণার রূক্ষভূমি, স্বল্পতৃণ প্রান্তর, সবুজদ্বীপের মতো শাল পিয়ালের বনে আর ঢোল, ঢমসা, মাদৈলের দ্রিমিদ্রিমি প্রতিধ্বনি শোনা যায় না। পরবে আগত নতুন বিটিজামাই ফিরে যায় নিজ গাঁয়ে। মাংস, পিঠা, ঘিয়ের পোড়া পোড়া গন্ধ হারিয়ে যায় ঈষৎ শীতল বাতাসে। শুধু অনার্য সভ্যতার প্রতিনিধিদের একান্ত নিজস্ব বাঁদনা পরবের স্মৃতিটুকু বেঁচে থাকে মনের গভীরে। আবারো দিন গোণা শুরু হয়,-- নাচ-গান-বাজনা, মকর-করম-বাঁদনা!