ইন্দ্রনাথ মজুমদার

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ইন্দ্রনাথ মজুমদার
জন্ম
মৃদুলকান্তি মজুমদার

১৯৩৩
দশানী গ্রাম খুলনা ব্রিটিশ ভারত (বর্তমানে বাংলাদেশ)
মৃত্যু৯ মে ২০১৩(2013-05-09) (বয়স ৭৯–৮০)
পেশাপুস্তক বিক্রয় ও প্রকাশনা
সন্তানকনিষ্ঠ পুত্র তুষার মজুমদারসহ দুই পুত্র

ইন্দ্রনাথ মজুমদার (১৯৩৩ - ২০১৩) ছিলেন একজন খ্যাতনামা গ্রন্থপঞ্জী, দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের সংগ্রাহক এবং বিদগ্ধ প্রকাশক। [১] কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের পুরোনো দুর্লভ গ্রন্থের অন্যতম বড় সংগ্রাহক, সংরক্ষক, শীর্ষস্থানীয় বিক্রেতা ও কলকাতার সুবর্ণরেখা প্রকাশনা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। অবনীরঞ্জন রায়ের সঙ্গে কথাশিল্প পাবলিশিং হাউস নামে আরো একটি প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। [২]

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন[সম্পাদনা]

ইন্দ্রনাথ মজুমদারের জন্ম ব্রিটিশ ভারতের অধুনা বাংলাদেশের খুলনা জেলার দশানী গ্রামে। তার পড়াশোনা রংপুরের মামারবাড়িতে।[৩] জন্মের পর তার ঠাকুরমা নামকরণ করেছিলেন মৃদুলকান্তি। খামখেয়ালি প্রকৃতির বালক বই পড়তে ভালবাসতেন। ঠাকুরমার দেওয়া 'মৃদুল' নাম তার পছন্দের হয়নি। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসের গুণেই নিজের নাম পরিবর্তন করে ইন্দ্রনাথ রাখেন। [৪]পরবর্তী কালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য তাকে বলতেন, কলেজ স্ট্রিটের মটরু মিয়া [৫]তবে ইন্দ্রনাথের স্কুলের গণ্ডি পেরোনো সম্ভব হয় নি। তার পিতা কাজ করতেন কলকাতার ইছাপুরের রাইফেল ফ্যাক্টরিতে। স্বাধীনতার পর ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় চলে আসেন। স্থানীয় জাতীয় ক্রীড়া ও শক্তি সংঘের শম্ভুনাথ মল্লিকের ঘনিষ্ঠ ও তার সংঘের স্বেচ্ছাসেবক হন। ফুটপাথ থেকে বই কিনে পাড়ার ছেলেপুলেদের পড়াতেন। ইছাপুরের 'অনুশীলন' নামের এক সমিতির লাইব্রেরি তৈরি করেন। সেই সূত্রেই ইন্দ্রনাথ গ্রন্থাগার আন্দোলনের কর্মী হয়ে প্রবীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘোরেন ‘গ্রন্থাগার’ পত্রিকায় অল্পস্বল্প লিখতে থাকেন। ধীরে ধীরে তিনি গ্রন্থাগারিকদের বৃত্তে পরিচিতি লাভ করেন। [৪]

কর্মজীবন[সম্পাদনা]

শেষে শম্ভুনাথের আমন্ত্রণে কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা অতুল্য ঘোষ পশ্চিমবঙ্গের অভাবী ও মেধাবী ছাত্রদের জন্য পাইকপাড়া যে বিধান ছাত্রাবাস স্থাপন করেছিলেন [৬] সেখানে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে লাইব্রেরিয়ান কাম সুপারের কাজ পান। [৪] একশত টাকা মাসিক মাইনাসহ থাকা-খাওয়া সব ফ্রি। রাজ্যের নানা জেলার মেধাবী ছাত্ররা যেমন, রাধারমণ চক্রবর্তী, ইতিহাসবিদ অলোক রায়, নকশাল নেতা, যেমন সন্তোষ রানা, অসীম চট্টোপাধ্যায় প্রমুখেরা ছিলেন ছাত্রাবাসের আবাসিক। রাজনৈতিক আন্দোলনের চাপে এবং ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে বিধান ছাত্রাবাস বন্ধ হয়ে গেলে, জীবিকা নির্বাহে ইন্দ্রনাথ শুরু করেন পুরানো বই কেনা-বেচার ব্যবসা কলেজ স্ট্রিট সংলগ্ন মহাত্মা গাধী রোডের এক ভাঙাচোরা বাড়ির দোতলায়। নাম দেন সুবর্ণরেখা। তবে আগে থেকেই তার নিয়মিতই কলেজ স্ট্রিটে যাতায়াত ছিল। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে অবনীরঞ্জন রায়, অভিনেত্রী সীতা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যৌথ ভাবে কথাশিল্প পাবলিশিং হাউস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখান থেকেই নির্মাল্য আচার্য সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথমে যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত হত বাংলা সাহিত্য ত্রৈমাসিক, এক্ষণ। সেই সূত্রেই বহু বিশিষ্টজনের সঙ্গে পরিচিতি ঘটে ইন্দ্রনাথের। এরা হলেন- নির্মাল্য আচার্য, শক্তি, সুনীল আর বেলাল চৌধুরী[৪] সাহিত্যিকদের সাহিত্যিক কমলকুমার মজুমদার ছিলেন নিঃসন্তান। পরে ইন্দ্রনাথ হয়ে যান তার সন্তানসম ও ঘনিষ্ঠ সহচর। [৫] কিন্তু কথাশিল্প-এর ব্যবসা ঠিক মত না চলার কারণে ইন্দ্রনাথ সুবর্ণরেখা র মাধ্যমে নিজের ব্যবসার জন্য বাংলার তৎকালীন বইপোকাদের জেনে তিনি বই কেনা বেচা শুরু করেন। সব ধরনের পাঠকের চাহিদার ঠিক বুঝতে পারতেন আর তার সর্বোত্তম পাঠকের কাছে তার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বই দুর্লভ হলেও ব্যবস্থা করে দিতেন। স্বাভাবিক কারণেই,আবাল্য পুস্তকপ্রেমী ও উদার মনোভাবের ইন্দ্রনাথের বন্ধুর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ঘটে। তাদের মধ্যে ছিলেন- অমর্ত্য সেন, অশোক রুদ্র, অমিয় বাগচী, অশোক মিত্র, সোমনাথ হোড়, নির্মলচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় ও আরও অনেকে। [৬] ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে ইন্দ্রনাথ মজুমদার শান্তিনিকেতনে 'সুবর্ণরেখা'-র এটি শাখা খোলেন।

পুস্তক কেনা-বেচা ছাড়াও ইন্দ্রনাথ মজুমদার প্রকাশ করেছেন বহু গ্রন্থ। তার 'সুবর্ণরেখা' হতে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়- মতি নন্দীর ক্রিকেট রেকর্ডস (১৮৭৬-১৯৬৬)। ইন্দ্রনাথ তার গুরুপ্রতিম কমলকুমার মজুমদারের সমস্ত গ্রন্থ, সম্পাদিত পত্রিকা অঙ্ক ভাবনা এবং নির্মাল্য আচার্যের সম্পাদনায় এক্ষণ এর প্রকাশনা ও বিপণনের ব্যবস্থাপক ছিলেন। ইন্দ্রনাথ নির্মাল্য আচার্যের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। নির্মাল্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে, ইন্দ্রনাথ তার উদার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। তিনি নিজে তাকে বোম্বাইয়ের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেন নি। নির্মাল্য আচার্যের মৃত্যুর পরই এক্ষণ প্রকাশনা বন্ধ করে দেন। 'সুবর্ণরেখা' হতে উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ হল-

  • দ্য ট্রুথ ইউনাইডস্: এসেজেস্ ইন ট্রাইবিউটস্ টু সমর সেন (১৯৮৫) অশোক মিত্র রচিত
  • গ্রাম বাংলার ইতিহাস (ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারস্ রচিত 'অ্যানালস অফ রুরাল বেঙ্গল') -এর বঙ্গানুবাদ। অনুবাদক - অসীম চট্টোপাধ্যায়
  • জীবন পিয়াসা (আরভিং স্টোন রচিত 'লাস্ট ফর লাইভ') এর বঙ্গানুবাদ। অনুবাদক- নির্মলচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়
  • মুঘলযুগে কৃষি-অর্থনীতি ও কৃষক বিদ্রোহ - গৌতম ভদ্র রচিত
  • ইমান ও নিশান - গৌতম ভদ্র রচিত
  • ভারতীয় মহাবিদ্রোহ - প্রমোদ সেনগুপ্ত রচিত

[৬]

মৃত্যু[সম্পাদনা]

ইন্দ্রনাথ মজুমদার ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ মে (১৪২০ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ) বৃহস্পতিবার বিকেল ৩.৩০ টায় দক্ষিণ কলকাতার এক হাসপাতালে পরলোক গমন করেন।[২] তার কনিষ্ঠ পুত্র তুষার মজুমদার বর্তমানে প্রকাশনা সংস্থাটির দেখাশোনা করেন। ইন্দ্রনাথ মজুমদারের মৃত্যুর পর ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে তার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেখা ও সাক্ষাৎকার নিয়ে একটি স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ ঘটিগরম নামে প্রকাশিত হয়।[৭]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "A rare man of books, words"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৪-২৯ 
  2. "Antique book dealer passes away"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৪-২৯ 
  3. "Bengal Cannes"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৫-০২ 
  4. "পৃথিবী এক বারই পায়, দ্বিতীয়টি মেলে না"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৫-০১ 
  5. "একজন লেখকের অঙ্ক শেখা দরকার, বলেছিলেন কমলকুমার"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৫-০১ 
  6. "OBITUARY: INDRANATH MAJUMDAR (1933-2013)- A TRIBUTE"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৫-০৩ 
  7. মজুমদার, ইন্দ্রনাথ। ঘটিগরম। সপ্তর্ষি প্রকাশন, কলকাতা। আইএসবিএন 978-93-8270-678-6