ইসলামে জোনাহ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

Yunus
يُونُس‎
Jonah
পূর্বসূরীAlyasa
উত্তরসূরীArramayah
পিতা-মাতা

ইউনূস ইবনে মাত্তা (আরবি: يُونُس ٱبْن مَتّىٰ) হলেন ইসলাম ধর্মে আল্লাহর একজন নবী, যিনি হিব্রু বাইবেলে উল্লিখিত আমিত্তয়ের পুত্র যোনা বা ইউনূসের সমতুল্য।[১] ইউনূস হিব্রু বাইবেলের বারোজন ক্ষুদ্র নবীর মধ্যে একমাত্র ব্যক্তি যার নাম কুরআনে উল্লেখ রয়েছে।[২] কুরআনের দশম সূরাটি, সূরা ইউনুস, তার নামেই নামকরণ করা হয়েছে।[৩]

কুরআনে আল্লাহর রাসূল হিসেবে এবং যুল-নুন (আরবি: ذُو ٱلنُّوْن) তথা "মাছওয়ালা" নামে বেশ কয়েকবার ইউনূসের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

[৪]

কুরআনে[সম্পাদনা]

সূরা আল-আম্বিয়া (২১:৮৭) এবং সূরা আল-ক্বলাম (৬৮:৪৮)-এ, ইউনুস (আ.)কে "যুন নুন" (আরবি: ذُو ٱلنُّوْن) বলা হয়েছে যার আভিধানিক অর্থ "মাছের অধিপতি"। সূরা আন-নিসা (৪:১৬৩) এবং আল-আনআম (৬:৮৬)-এ, তাঁকে "আল্লাহর রাসূল" হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

সূরা আস-সাফফাত (৩৭: ১৩৯-১৪৮) নবী ইউনুস (আ.)-এর পূর্ণ কাহিনী বর্ণনা করে:

  • হযরত ইউনুস (আ.) আল্লাহর আদেশ অমান্য করে পালিয়ে যান এবং একটি পূর্ণ বোঝাই জাহাজে আশ্রয় নেন।
  • জাহাজে যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য তাঁকে পানিতে নিক্ষেপের সিদ্ধান্ত হয়।
  • একটি তিমি তাঁকে গিলে ফেলে এবং তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারেন।
  • তিনি আন্তরিকভাবে তওবা করেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করেন।
  • আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করে তিমি থেকে মুক্তি দেন। তিনি অসুস্থ অবস্থায় সমুদ্রতীরে উৎক্ষিপ্ত হন।
  • আল্লাহ তাঁর উপর একটি লতা জাতীয় উদ্ভিদ জন্মাতে আদেশ দেন যা তাঁকে ছায়া ও পুষ্টি প্রদান করে।
  • আল্লাহ তাঁকে পুনরায় এক লক্ষাধিক লোকের নিকট প্রেরণ করেন।
  • মানুষেরা তাঁর কথায় বিশ্বাস করে, ফলে আল্লাহ তাদেরকে কিছু সময়ের জন্য আরাম-আয়েশে বাঁচার সুযোগ দেন।

কুরআনে হযরত ইউনুস (আ.)-এর বংশের উল্লেখ না থাকলেও, মুসলিম ঐতিহ্য অনুসারে তিনি বিনইয়ামীন গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

হাদিসে[সম্পাদনা]

হাদিসে নবী যুনুস (আ.)-এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায় নবী যুনুস (আ.)-এর নাম কিছু ঘটনায় প্রশংসা ও ভক্তি সহকারে উল্লেখিত হয়েছে।

ইসলামের ইতিহাস অনুসারে, দশ বছর ওহি লাভের পর, নবী মুহাম্মদ (সা.) মক্কা ছেড়ে তা'ইফ শহরে যান, এই আশায় যে শহরের নেতৃবৃন্দ হয়তো তাকে সেখান থেকে তার বাণী প্রচার করার অনুমতি দেবেন। কিন্তু, সেখানকার লোকেরা তাকে প্রত্যাখ্যান করে। মক্কার কুরাইশ গোত্রের দুই সদস্য উতবা এবং শায়বার বাগানে তিনি আশ্রয় নেন। খাবার হিসেবে তারা নিজেদের দাস আদ্দাসকে আঙ্গুর পরিবেশনের জন্য পাঠায়। মুহাম্মদ (সা.) আদ্দাসকে তাঁর নিজ শহর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন, এবং দাসটি উত্তর দেয় যে সে নিনেভেহ শহরের অধিবাসী। মুহাম্মদ (সা.) আশ্চর্য হয়ে বলেন “ন্যায়পরায়ণ যুনুস ইবনে মাত্তাইয়ের শহর!” আদ্দাস অত্যন্ত অবাক হন, কারণ তিনি জানতেন যে মূর্তিপূজক আরবদের নবী যুনুস (আ.)-এর সম্পর্কে কোনও জ্ঞান ছিল না। এরপর তিনি মুহাম্মদ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেন যে, তিনি কিভাবে এই ব্যক্তি সম্পর্কে জানেন। "আমরা ভাই," মুহাম্মদ (সা.) উত্তর দিলেন। "যুনুস আল্লাহর নবী ছিলেন এবং আমিও আল্লাহর নবী।" আদ্দাস সাথে সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর হাত ও পায়ে চুম্বন করেন।

ইমাম বুখারীর হাদিস সংকলনে মুহাম্মদ (সা.)-এর একটি উক্তি বর্ণনা করা হয়েছে যে, "কারো উচিত নয় বলা যে, আমি যুনুস (আ.) থেকে উত্তম।"  মুহাম্মদ (সা.) এর সমসাময়িক এবং তাঁর চেয়ে বয়সে বড় ইবনে আবু আস-সালত বলেছেন, যদি যুনুস (আ.) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা না করতেন, তবে তিনি পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত মাছের পেটের ভিতরে আটকে থাকতেন। কিন্তু, তাঁর প্রার্থনার কারণে, যুনুস (আ.) "মাছের পেটের মধ্যে মাত্র কয়েকদিন ছিলেন"।

নবম শতাব্দীর পারস্যের ইতিহাসবিদ আল-তাবারি লিখেছেন, যখন যুনুস (আ.) মাছের ভিতরে ছিলেন, "তার কোনও হাড় বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি"। আল-তাবারি আরও লিখেছেন যে আল্লাহ মাছের শরীরকে স্বচ্ছ করে দিয়েছিলেন, যাতে যুনুস (আ.) সমুদ্রের "বিস্ময়কর জিনিস" দেখতে পান এবং যুনুস (আ.) সমস্ত মাছকে আল্লাহর প্রশংসা করতে শুনতে পান। দশম শতাব্দীর কবি কিসাই মারভাজি লিপিবদ্ধ করেছেন যে, যুনুস (আ.)-এর জন্মের সময় তার পিতার বয়স ছিল সত্তর বছর এবং অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি মারা যান। শুধু একটি কাঠের চামচ রেখে যান যুনুস (আ.)-এর মায়ের জন্য, যা পরবর্তীতে অফুরন্ত সম্পদের উৎসে পরিণত হয়।

সমাধি[সম্পাদনা]

নিনেভের বর্তমান অবস্থান পাঁচটি গেটের খননকাজ, চার পাশে দেয়ালের কিছু অংশ এবং দুটি বড় ঢিবি দ্বারা চিহ্নিত: কুয়ুঞ্জিক পাহাড় এবং নবী ইউনুসের পাহাড়। নবী ইউনূসের উপরে অবস্থিত একটি মসজিদ ইউনূস (জোনাহ) কে উৎসর্গ করা হয়েছিল এবং এতে একটি মাজার ছিল যেটি মুসলমান এবং খ্রিস্টান উভয়ই ইউনূসের সমাধিস্থল হিসাবে শ্রদ্ধা করত। এই সমাধিটি ছিল একটি জনপ্রিয় তীর্থস্থান এবং সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে একতার প্রতীক। ২৪ জুলাই, ২০১৪ তারিখে, ইসলামিক স্টেট মূর্তিপূজক বলে মনে করা ধর্মীয় পবিত্রস্থানগুলিকে ধ্বংস করার অভিযানের অংশ হিসাবে সমাধিটি ধ্বংস করে দেয়।

২০১৭ সালের জানুয়ারীতে মোসুলকে ইসলামিক স্টেটের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করার পরে, ধ্বংস হওয়া মসজিদের নীচে প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীর প্রথমার্ধের সময়ে এসারহাদন দ্বারা নির্মিত একটি অ্যাসিরিয়ান প্রাসাদ আবিষ্কৃত হয়েছিল। আইএসআইএস ব্ল্যাক মার্কেটে বিক্রি করার জন্য প্রাসাদটির মূল্যবান জিনিস লুট করেছিল, কিন্তু যেগুলো বহন করা আরও কঠিন ছিল সেগুলো অক্ষত রয়ে যায়।  ধর্মীয় নিদর্শন সংগ্রহে আগ্রহী হবি লবি, নিনেভ সহ ইসলামিক স্টেটের কাছ থেকে অনেক অবৈধ প্রত্নসামগ্রী কিনেছিল।

অন্যান্য মুসলিম সমাধি[সম্পাদনা]

ইউনূসের অন্যান্য সমাধির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ইসরায়েলের প্রাচীন স্থান গাথ-হেফারে অবস্থিত আরব গ্রাম মাশহাদ; ফিলিস্তিনি ওয়েস্ট ব্যাংক শহর হালহুল, হেব্রনের ৫ কিমি (৩.১ মাইল) উত্তরে; এবং লেবাননের সারেপ্টা শহরের কাছে একটি অভয়ারণ্য। আরেকটি প্রচলিত মত অনুযায়ী ইউনূসের সমাধিটি গিভাত ইয়োনাহ নামে একটি পাহাড়ে অবস্থিত, যা ইসরায়েলের আশদোদ শহরের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত, এখানে একটি আধুনিক বাতিঘর রয়েছে।

তুরস্কের দিয়ারবাকির শহরেও ইউনুসের একটি সমাধি পাওয়া যায়, এটি ফাতিহ পাশা মসজিদের মিহরাবের পিছনে অবস্থিত। এভলিয়া চেলেবি তার সেয়াহাতনামেতে উল্লেখ করেছেন যে তিনি ইউনূসের সমাধি পরিদর্শন করেছিলেন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. says, Quran Academy। "5 Lessons from the Story of Prophet Yunus"Quran Academy। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১২ 
  2. Encyclopedia of Islam, Yunus, pg. 348
  3. Johns 2003, পৃ. 66।
  4. Vicchio 2008, পৃ. 67।