ইসলামে তাওরাত

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

তাওরাত (আরবি: ٱلتَّوْرَاةَ) হল আরবিতে ব্যবহৃত তোরাহ শব্দের সমার্থক। মুসলিমরা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ্‌ ইসরাঈলের নবী ও বার্তাবাহকদের কাছে এই পবিত্র গ্রন্থ প্রেরণ করেছেন। কোরআন শরীফে 'তাওরাত' শব্দটি আঠারো বার এসেছে। মুসলমানরা যখন তাওরাতের ঐতিহ্য সম্পর্কে কথা বলে, তারা তখন কেবল পেন্টাটিউক (মূসা (আ.)-এর পাঁচটি গ্রন্থ) বোঝায় না, বরং হিব্রু বাইবেলের অন্যান্য বই, তালমুদিক এবং মিদরাশিক ব্যাখ্যাও অন্তর্ভুক্ত করে।[১]

আমি তাওরাত অবতীর্ণ করেছিলাম, তাতে ছিল সঠিক পথের দিশা ও আলো। অনুগত নাবীগণ এর দ্বারা ইয়াহূদীদেরকে ফায়সালা দিত। দরবেশ ও আলিমরাও (তাই করত) কারণ তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের রক্ষক করা হয়েছিল আর তারা ছিল এর সাক্ষী। কাজেই মানুষকে ভয় করো না, আমাকেই ভয় কর, আর আমার আয়াতকে নগণ্য মূল্যে বিক্রয় করো না। আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, সে অনুযায়ী যারা বিচার ফায়সালা করে না তারাই কাফির।

— সূরা মায়িদাহ, আয়াত ৪৪
তোরাহ

কুরআনে তাওরাত[সম্পাদনা]

কুরআনে 'তাওরাত' শব্দটি আঠারো বার এসেছে এবং মুসা (আ.)-এর নাম উল্লেখিত হয়েছে ১৩৬ বার। কুরআনে কখনো বলা হয়নি যে শুধুমাত্র মুসা (আ.)- কেই তাওরাত দেওয়া হয়েছিল। বরং কুরআনে উল্লেখ আছে যে অন্যান্য নবীরাও তাওরাতের মাধ্যমে শাসন করেছেন। কুরআন অনুসারে, আল্লাহর নির্দেশাবলী ধারণকারী আয়াতগুলোই হলো তাওরাত।

কিন্তু কিভাবে তারা আপনার কাছে বিচারের জন্য আসে, অথচ তাদের কাছে রয়েছে তাওরাত, যাতে স্পষ্টভাবে আল্লাহর বিধান রয়েছে? এমনকি এরপরও, তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। কারণ তারা প্রকৃত বিশ্বাসী নয়। - কুরআন, সূরা আল মায়িদা (৫), আয়াত ৪৩

কুরআন (৫:৪৫)-এ উল্লেখিত শরীয়ত বিধান:[সম্পাদনা]

এবং (হে নবী) তাতে (তাওরাতে) আমি তাদের জন্য লিখে দিয়েছিলাম যে, জীবনের বদলে জীবন, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত, আর ক্ষতের বদলে সমান প্রতিশোধ রয়েছে। তবে যে ক্ষমা করে দেয় তা তার জন্য কাফ্‌ফারা হয়ে যাবে। আর যারা আল্লাহ্‌ যা নাযিল করেছেন তা দ্বারা বিচার-ফয়সালা না করে তারাই যালিম। - কুরআন, সূরা আল মায়িদা (৫), আয়াত ৪৫

বাইবেলেও অনুরূপ নির্দেশনা রয়েছে:[সম্পাদনা]

*“আর যদি আরও অনিষ্ট হয়, তবে প্রাণের পরিবর্তে প্রাণ, চোখের পরিবর্তে চোখ, দাঁতের পরিবর্তে দাঁত, হাতের পরিবর্তে হাত, পায়ের পরিবর্তে পা, দগ্ধের পরিবর্তে দগ্ধ, ক্ষতের পরিবর্তে ক্ষত, চাবুকের পরিবর্তে চাবুক দিবে।”  - বাইবেল, এক্সোডাস, অধ্যায় ২১, আয়াত ২৩-২৫

সূরা ৭:১৫৭ অনুসারে, ইঞ্জিল (যীশুর প্রতি অবতীর্ণ মূল গ্রন্থ) এবং তাওরাত উভয় ধর্মগ্রন্থে মুহাম্মাদ (সা.)-এর বর্ণনা এসেছে:[সম্পাদনা]

এরা সেই নবীকে অনুসরণ করে, যে নিরক্ষর নবী; যার সম্পর্কে তারা নিজেদের কাছে বিদ্যমান তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পায়। সে তাদেরকে সৎকর্মের আদেশ দেয়, অসৎকর্মে নিষেধ করে, পবিত্র বস্তু তাদের জন্য হালাল করে দেয় এবং অপবিত্র বস্তু তাদের জন্য হারাম করে দেয়। তাদের থেকে ভারী বোঝা এবং যে শৃঙ্খলে তারা আবদ্ধ ছিল, অপসারণ করে দেয়। সুতরাং যারা ঈমান আনে তার প্রতি, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং তার সাথে নাযিলকৃত নূরের (কুরআনের) অনুসরণ করে, তারাই হল সফলকাম।  - কুরআন, সূরা আল আরাফ (৭), আয়াত ১৫৭

তাওরাত সম্পর্কে ঈসা (আ.)- এর জানার উল্লেখ রয়েছে সূরা ৫:১১০-এ:[সম্পাদনা]

*“যখন আল্লাহ বলবেন, হে মারইয়াম-তনয় ঈসা!  তোমার প্রতি এবং তোমার মাতার প্রতি আমার অনুগ্রহ স্মরণ কর। যখন আমি তোমাকে পবিত্র আত্মা সহ সবল করেছিলাম এবং তুমি শৈশবে ও প্রাপ্তবয়সে মানুষের সাথে কথা বলতে; এবং যখন আমি তোমাকে লিখন, প্রজ্ঞা, তাওরাত এবং ইঞ্জিল শিক্ষা দিয়েছিলাম; এবং যখন তুমি আমার অনুমতি নিয়ে কাদামাটি থেকে পাখির মত আকৃতি নির্মাণ করে তাতে ফুঁ দিলে তা আমার অনুমতিক্রমে পাখি হয়ে যেত; এবং তুমি আমার অনুমতিক্রমে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে আরোগ্য করতে এবং তুমি মৃতকে জীবিত করতে—আর আমি যখন তোমাকে বনী-ইসরাঈলের হাত থেকে রক্ষা করলাম যখন তুমি তাদের কাছে স্পষ্ট নিদর্শনাবলী নিয়ে আগমন করলে; তখন তাদের মধ্যে যারা কাফের হয়ে গিয়েছিল তারা বলেছিল, এটা তো স্পষ্ট জাদু ছাড়া আর কিছুই নয়।” - কুরআন, সূরা আল মায়িদা (৫), আয়াত ১১০

কুরআনের কোন কোন আয়াত হিব্রু বাইবেলের অন্যান্য অংশ থেকে পুনরাবৃত্ত হয়েছে। এর একটি উদাহরণ হলো সূরা ৪৮:২৯:[সম্পাদনা]

মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল আর তাঁর সাথীরা কাফেরদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল। আপনি তাদেরকে রুকূ ও সিজদা করতে দেখবেন, আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করতে দেখবেন। তাদের চিহ্ন তাদের চেহারায় রয়েছে, সিজদার দাগ হিসেবে। এটাই তাদের বর্ণনা তাওরাতে। আর ইঞ্জিলে তাদের বর্ণনা এই যে, তারা যেমন কোন চারা যা থেকে তার নিজস্ব অঙ্কুর বের করে, অতঃপর তা (অঙ্কুর) তাকে শক্তিশালী করে, ফলে সে স্থুল হয় এবং সে স্বকীয় কাণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে যায়; ফলে চাষীদেরকে আনন্দিত করে দেয়, যাতে আল্লাহ্‌ কাফেরদেরকে এদের দ্বারা ক্রুদ্ধ করেন। আল্লাহ্‌ তাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, তাদের জন্য ক্ষমা ও মহাপুরস্কারের ওয়াদা করেছেন। -- কুরআন, সূরা আল ফাত্‌হ (৪৮), আয়াত ২৯

বাইবেল - গীতসংহিতা[সম্পাদনা]

গীতসংহিতা ১:৩

“সে হবে সেই বৃক্ষের মতো যা প্রবাহিত নদীর ধারে রোপিত, যে তার নিজস্ব কালে ফল দেয়। তার পাতা কখনো শুকিয়ে যাবে না, সে যা কিছু করবে তাতে সফলতা আসবে।”

গীতসংহিতা ৭২:১৬

"পাহাড়ের শীর্ষেও মুষ্টিমেয় শস্য জন্মাবে, লেবাননের বনভূমির মতো তার ফলন দুলে উঠবে। নগরের অধিবাসীরা মাঠের ঘাসের ন্যায় প্রস্ফুটিত হবে।"

গীতসংহিতা ৯২:১৪

“বার্ধক্যেও তারা সফল ও সবল থাকবে।”

কুরআন[সম্পাদনা]

সূরা আল-কাসাস (২৮:৪৮-৪৯) “কিন্তু যখন আমার কাছ থেকে তাদের কাছে সত্য এসে পৌঁছলো, তারা বললো, ‘মূসাকে যা দেওয়া হয়েছিল তাকেও যদি এরূপ দেওয়া হতো।’ ওরা কি পূর্বে মূসাকে যা দেওয়া হয়েছে তা অস্বীকার করেনি? তারা বলে, ‘এ দুটোই জাদু, পরস্পরের সমর্থক। আমরা উভয়কেই প্রত্যাখ্যান করি।’ বল, ‘তবে আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন এক কিতাব নিয়ে এসো, যা এ দুটোর চেয়ে অধিক হেদায়েতকারী, আমি তার অনুসরণ করব, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’”

কুরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে[সম্পাদনা]

ইসলামিক ব্যাখ্যাশাস্ত্রে,  "তাফসির আল কুরআন বি-ল-কিতাব" (আরবি:  تفسير القرآن بالكتاب) একটি পদ্ধতি যেখানে বাইবেলের মাধ্যমে কুরআনের ব্যাখ্যা করা হয়।  এই পদ্ধতি বাইবেলের তাওরাত এবং ইঞ্জিল-এর আরবি সংস্করণগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে, যাতে কুরআনের অধ্যয়নে আলোকপাত করা যায় এবং এর ব্যাখ্যাগত গভীরতা যোগ করা যায়।  কুরআন এবং বাইবেলের উল্লেখযোগ্য 'মুফাসসিরুন' (ব্যাখ্যাকারী) যারা বাইবেলের আয়াতসমূহ কুরআনের সাথে যুক্ত করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আল-আন্দালুসের আবু আল-হাকাম আব্দ আল-সালাম ইবন আল-ইশবিলি এবং ইব্রাহিম ইবন উমর ইবন হাসান আল-বিকাই।[২]

শব্দার্থবিদ্যা[সম্পাদনা]

ইংরেজিভাষী মুসলমানদের মধ্যে 'তাওরাত' এবং 'তোরাহ' শব্দ দুটির ব্যবহার নিয়ে কিছুটা দ্ব্যর্থতা রয়েছে। কুরআন এবং হাদিসের আরবিতে কেবল একটি শব্দ আছে, তাওরাত। সাধারণত, ইংরেজিতে এই শব্দ দুটি পরস্পরের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়। তবে, কিছু মুসলমান শুধুমাত্র মূল স্বর্গীয় বাণী বোঝাতে 'তাওরাত' শব্দটি সংরক্ষণ করতে পছন্দ করেন, যে বাণীটি, কিছু মুসলমানের বিশ্বাস অনুসারে, সম্ভবত বাবিলীয় বন্দিদশার সময় এবং এজরা (উজাইর) (এবং মহাসভার পুরুষদের) কর্তৃক পুনর্লিখনের মাধ্যমে পরবর্তীতে বিকৃত হয়ে গেছে।

তোরাহ-এর গুরুত্ব[সম্পাদনা]

'তাওরাত' শব্দটি কুরআনে আঠারোবার এসেছে এবং মুসা (আ.)-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে ১৩৬ বার। কুরআন শরীফে কোথাও এ কথা বলা হয়নি যে শুধুমাত্র মুসা (আ.) তাওরাত অনুসারে শিক্ষা দিয়েছিলেন। বরং হারুন (আ.) সহ পরবর্তী সকল ইব্রাহিমীয় নবীগণই তাওরাতের বিধি-বিধান প্রচারে ব্যবহার করেছেন। কুরআনে বলা হয়েছে যে, তাওরাতে প্রজ্ঞাপূর্ণ বাণী ছিল এবং ইসরাইলের পরবর্তী সমস্ত নবী, ধর্মযাজক, রাব্বি এবং সাধুগণ এই তাওরাতের আইনকে গাইডলাইন হিসেবে ব্যবহার করেছেন। নবীদের বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে, যা নির্দেশ করে তাওরাত গ্রন্থটি কেবল মুসা (আ.)-এর জন্যই ছিল না।

কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রাথমিক ধর্মগ্রন্থগুলোতে, যার মধ্যে মুসা (আ.) এর ধর্মগ্রন্থও রয়েছে, সেগুলোতে ইসলামী আইনের মৌলিক দিকগুলি সুস্পষ্ট। এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে তাওরাতে শেষ দিবস সম্পর্কে এবং জান্নাত ও জাহান্নামের ধারণাগুলি সম্পর্কে তথ্য রয়েছে। এছাড়াও, কুরআনে উল্লেখ করা আছে যে ঈসা (আ.) তাওরাত সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Isabel Lang Intertextualität als hermeneutischer Zugang zur Auslegung des Korans: Eine Betrachtung am Beispiel der Verwendung von Israiliyyat in der Rezeption der Davidserzählung in Sure 38: 21-25 Logos Verlag Berlin GmbH, 31.12.2015 আইএসবিএন ৯৭৮৩৮৩২৫৪১৫১৪ p. 98 (German)
  2. McCoy, R. Michael (২০২১-০৯-০৮)। Interpreting the Qurʾān with the Bible (Tafsīr al-Qurʾān bi-l-Kitāb) (ইংরেজি ভাষায়)। Brill। আইএসবিএন 978-90-04-46682-1