প্রণয়ের দর্শন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

প্রেমের দর্শন হল সামাজিক দর্শন এবং নীতিশাস্ত্রের একটি শাখা যা প্রেমের ধারণা, প্রকৃতি এবং গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করে।[১] এটি প্রেমের বিভিন্ন রূপ, যেমন রোমান্টিক প্রেম, পারিবারিক প্রেম, বন্ধুত্বপূর্ণ প্রেম, এবং ভালোবাসার মতো ধারণাগুলো অন্বেষণ করে। প্রেমের দর্শন প্রেমের নীতিগত দিকগুলিও পরীক্ষা করে, যেমন প্রেম কতটা গুরুত্বপূর্ণ, প্রেমের প্রতি আমাদের কী কর্তব্য এবং প্রেমের ক্ষেত্রে আমাদের কী ধরনের আচরণ গ্রহণযোগ্য।[২]

প্রচলিত তত্ত্ব[সম্পাদনা]

ভালোবাসা কী এবং এর কাজ কী তা ব্যাখ্যা করার জন্য অনেকগুলো ভিন্ন তত্ত্ব রয়েছে। প্রচলিত তত্ত্বগুলোর মধ্যে রয়েছে: মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব, বিবর্তনবাদী তত্ত্ব এবং আধ্যাত্মিক তত্ত্ব। অধিকাংশ মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব ভালোবাসাকে একটি খুবই ইতিবাচক আচরণ হিসেবে দেখে। বিবর্তনবাদী তত্ত্বগুলো বিশ্বাস করে যে ভালোবাসা প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার একটি অংশ। আধ্যাত্মিক তত্ত্বগুলো ভালোবাসাকে সৃষ্টিকর্তার একটি উপহার হিসেবে গণ্য করে। সেইসাথে, কিছু তত্ত্ব ভালোবাসাকে একটি অব্যক্ত রহস্য হিসেবে আখ্যায়িত করে, অনেকটা এক আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার মতন।

পাশ্চাত্য ঐতিহ্য[সম্পাদনা]

শাস্ত্রীয় উৎস[সম্পাদনা]

প্রেম নিয়ে আলোচনার শাস্ত্রীয় দার্শনিক ধারার সূচনা প্লেটোর "সিম্পোসিয়াম" গ্রন্থে। প্রেমের ধারণাকে সংজ্ঞায়িত করতে প্লেটোর "সিম্পোসিয়াম" গভীরভাবে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ ও ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা করে। প্লেটো বিশেষভাবে প্রেমের তিনটি প্রধান সূত্র তুলে ধরেন, যেগুলো প্রেমের পরবর্তী দর্শনগুলিকেও প্রভাবিত করে।

  • দুই ধরনের প্রেমের ধারণা, একটি স্বর্গীয়, অন্যটি পার্থিব: টোবির কাকার মতে, দুই সহস্রাব্দেরও বেশি সময় পরে, "ফিসিনোস ভ্যালিসিয়াসের ভাষ্য অনুসারে, এই প্রেমগুলির মধ্যে একটিকে বলা যায় যুক্তিবাদী - অন্যটি প্রাকৃতিক - প্রথমটি…দর্শন ও সত্যের আকাঙ্ক্ষার উদ্রেক করে, দ্বিতীয়টি কেবলই লালসার উদ্রেক করে"।
  • অ্যারিস্টোফেনিসের আদি মানবের দ্বিখন্ডিত হবার ধারণা: ফ্রয়েড পরবর্তীতে তার "পুনরাবৃত্তির বাধ্যবাধকতা"র তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে এই পুরাকথা ব্যবহার করেছিলেন। "এই আদিম মানবদের সবকিছুই ছিলো দ্বিগুণ: চার হাত, চার পা, দুটি মুখ"।
  • প্লেটোর প্রেমের উর্ধ্বগতির তত্ত্ব: "...এক থেকে দুই, দুই থেকে সমস্ত সুন্দর রূপে, তারপর সুন্দর রূপ থেকে সুন্দর কর্মে, সুন্দর কর্ম থেকে সুন্দর ধারণায়, অবশেষে সুন্দর ধারণা থেকে পরম সৌন্দর্যের ধারণা লাভ করা"।

অ্যারিস্টোটল অপরদিকে, 'এরোস' (রোমান্টিক প্রেম) এর চেয়ে 'ফিলিয়া' (বন্ধুত্ব, স্নেহ) কে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। বন্ধুত্ব ও প্রেমের সম্পর্ক রেনেসাঁ যুগেও বেশ আলোচিত হয়েছে। রোমানদের মধ্যে সিসেরো বলেছেন ইংরেজি 'ফ্রেন্ডশিপ' মূলত এসেছে 'অ্যামর' (প্রেম) থেকে। এদিকে লুক্রেটিয়াস, এপিকিউরাসের কাজের ওপর ভিত্তি করে একদিকে "সমগ্র বিশ্বের দিকনির্দেশক শক্তি" রূপে ভেনাসের ভূমিকা বর্ণনা করেছেন আবার "প্রেমে আসক্ত হয়ে জীবনের সেরা বছরগুলো অলসতা ও ব্যভিচারে নষ্ট" করা ব্যক্তিদেরও সমালোচনা করেছেন।[৩]

গ্রিক পুরাণের 'এরোস,' রোমান পুরাণে যাকে কিউপিড বলা হয়, হলেন দুষ্টু প্রেমের দেবতা। তিনি দেবী আফ্রোদিতির সঙ্গী। এরোস দেবতা ও মানুষের মধ্যে প্রেমের আগুন জ্বালাবার ক্ষমতার জন্য পরিচিত। তাকে সাধারণত ধনুক-বাণ বা জ্বলন্ত মশাল হাতে চিত্রিত করা হয়। আফ্রোদিতির একান্ত অনুগত সন্তান হলেও তিনি অবাধ্য হিসেবেই পরিচিত।[৪]

  • ফিলিয়া: 'ফিলিয়া' হলো বন্ধুত্বভিত্তিক প্রেম বা ভ্রাতৃপ্রেম। অ্যারিস্টোটল তিন ধরণের বন্ধুত্ব ব্যাখ্যা করেছেন: "উপকারী" (যখন লাভের উদ্দেশ্য থাকে), "আনন্দদায়ক" (আনন্দের প্রত্যাশা থাকে) এবং "সৎ" (সত্যিকারের বন্ধুত্ব যেখানে কোন বাহ্যিক প্রত্যাশা থাকে না) ।
  • আগাপে: গ্রিক শব্দ 'আগাপে'র অর্থ হলো ভালবাসা। কারো মধ্যে সদিচ্ছা, পরোপকারিতা ইত্যাদির উপস্থিতি 'আগাপে' প্রেমকে নির্দেশ করে। এটি রোমান্টিক বা যৌন প্রেম নয়। বন্ধুত্বভিত্তিক 'ফিলিয়া' থেকেও আলাদা যেখানে ধর্মীয় দিকনির্দেশনা থেকে উদারতা ও সকলের প্রতি সহানুভূতি জড়িত থাকে।[৫]

পেত্রার্কিজম[সম্পাদনা]

প্রেমে-পীড়িত ক্যাটুলাস এবং অন্যান্য কবি যেমন হেলোইস, ১২শ শতাব্দীতে তাদেরকে 'ভালোবাসার আদালতে' তলব করা হয়। এসব চরিত্রদের কাহিনী থেকেই আভিজাত্যপূর্ণ ভালোবাসার ধারণাটি উদ্ভূত হয়, এবং এর থেকে পেট্রার্কিজম গঠিত হয়, যা আধুনিক যুগের প্রথম দিকে রোমান্টিক ভালোবাসার আলংকারিক ও দার্শনিক ভিত্তি তৈরি করে।[৬]

ফরাসি সংশয়বাদ[সম্পাদনা]

স্তঁদালের সময় থেকে একটি আরও সংশয়ী ফরাসি ঐতিহ্যের সূচনা লক্ষ্য করা যায়। স্তঁদালের 'স্ফটিককরণের' সূত্র থেকে বোঝা যায় যে প্রেমের জন্য একটি কল্পনাপ্রবণ মানসিকতা প্রয়োজন; কাউকে স্বপ্নের মতো নিখুঁত করে তোলার জন্য একটি মাত্র ঘটনাই যথেষ্ট। প্রুস্ত এই বিষয়টিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান যেখানে তিনি অনুপস্থিতি, দূরত্ব বা হিংসাকে প্রেমের জন্য অপরিহার্য অনুঘটক হিসেবে দেখেন। লাকাঁ এই ঐতিহ্যটিকে প্রায় উপহাসের পর্যায়ে নিয়ে যান তাঁর এই উক্তিতে, "ভালোবাসা মানে এমন কিছু দেওয়া যা তোমার কাছে নেই, এমন কাউকে যে আসলে নেই"। লাকাঁ-উত্তর যুগের ল্যুস ইরিগ্যারে এরপর এমন একটি পৃথিবীতে ভালোবাসার জন্য জায়গা খুঁজতে সংগ্রাম করেন যেখানে "অন্যজনকে একই রকম করে ফেলা হয়... যৌন মুক্তির নামে ভালোবাসার ক্ষতি করে শুধু যৌন আকর্ষণকে প্রাধান্য দেওয়া হয়"।[৭]

পূর্বের ঐতিহ্যসমূহ[সম্পাদনা]

ম্যাক্স ওয়েবার ধর্ম ও যৌনতার মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের যে বর্ণনা দিয়েছেন, সেই আলোকে ভারতে লিঙ্গ ও যোনির ভূমিকা কিংবা চীনে ইন এবং ইয়াং-এর মহাজাগতিক মেরুকরণের ধারণাকে পুরুষ ও নারী নীতির উপর ভিত্তি করে বোঝা সহজ হয়। মৈথুন বা পবিত্র যৌনতার মাধ্যমে তন্ত্র পবিত্র যৌনতার একটি সম্পূর্ণ ঐতিহ্য গড়ে তুলেছিল। বৌদ্ধধর্মের সাথে এর একীকরণের ফলে যৌন প্রেমকে আলোকিত হওয়ার পথ হিসাবে দেখা শুরু হয়। সারার ভাষায়, "পদ্ম এবং বজ্রের মাঝে যে আনন্দময় আনন্দ রয়েছে ... তা সমস্ত অপবিত্রতা দূর করে।"[৮]

কিছুটা ভিন্নরূপে, হিন্দু ঐতিহ্য বিয়ের মধ্যে প্রেমের ভিত্তি হিসেবে বন্ধুত্বকে গুরুত্ব দেয়। এই ধারণা প্রাচীন বেদের সময়ে ফিরে পাওয়া যায়।[৯]

কনফুসিয়াস কখনও কখনও প্রেমের একটি দর্শন (ধর্মের বিপরীতে) তৈরি করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন বলে বিবেচিত হন।[১০]

হিন্দুধর্মে ভালোবাসা[সম্পাদনা]

হিন্দুধর্মে ভালোবাসাকে ভক্তিমূলক ভালোবাসা বা ঐশ্বরিক উদ্দেশ্যের জন্য ভালোবাসা বলা হয়। হিন্দু সন্ন্যাসী ও দার্শনিক স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, "বিশ্বের সবকিছুই ঐশ্বরিক উৎসের এবং ভালবাসার যোগ্য। তবে এটা মাথায় রাখতে হবে যে পুরোটাকে ভালোবাসার মধ্যেই অংশগুলোকে ভালোবাসাও অন্তর্ভুক্ত।"[১১]

বৌদ্ধধর্মে ভালোবাসা[সম্পাদনা]

বৌদ্ধধর্মে ভালোবাসা সার্বজনীন হওয়ার কথা। আলোকপ্রাপ্ত হতে গেলে ভালোবাসাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য হতে হবে। ধম্মপদ নির্দেশ দেয় "ফ্যাকাশে পদ্মফুল যেমন ঝরে যায়, তেমনি করে তোমার আত্ম-প্রেমকেও মন থেকে ঝেড়ে ফেলো। বুদ্ধদেবের দেখানো নির্বাণের পথে, শান্তির পথে অবিচল থাক।"[১২]

কনফুসীয়বাদে ভালোবাসা[সম্পাদনা]

কনফুসীয়বাদে প্রেম মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কগুলোতে গুরুত্ব দেয়। 'রেন' কনফুসীয়বাদের একটি গুণ যার অর্থ পরোপকারী ভালোবাসা, এবং এটা তাদের শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এটি বিভিন্ন সামাজিক সম্পর্কের উপর জোর দেয়। কনফুসিয়াসের 'দ্য এনালেক্টস'-এর চতুর্থ গ্রন্থে বলা হয়েছে:

"4.1 মাস্টার বললেন, 'রেন'-এ বসতি স্থাপন করা সবচেয়ে সুন্দর পথ। যদি কেউ 'রেন'-এর মাঝামাঝি না থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে সেখান থেকে জ্ঞান কোথা থেকে আসবে?

4.7 মাস্টার বললেন, মানুষ তারা কেমন তাদের ধরণ অনুযায়ী ভুল করে। তাদের ভুলগুলো পর্যবেক্ষণ করে তুমি 'রেন' বুঝতে পার।"[১৩]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Irving Singer (৩১ মার্চ ২০০৯)। Philosophy of Love: A Partial Summing-Up। MIT Press। আইএসবিএন 978-0-262-19574-4। সংগ্রহের তারিখ ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ 
  2. Kephart, William (১৯৭০)। "The "Dysfunctional" Theory of Romantic Love: A research report"Journal of Comparative Family Studies1 (1): 26–36। জেস্টোর 41600756ডিওআই:10.3138/jcfs.1.1.26। সংগ্রহের তারিখ ৮ ডিসেম্বর ২০২১ 
  3. Lucretius, On the Nature of the Universe (1961) p. 27 and p. 163-5
  4. Kingsley-Smith, Jane (২০১০)। Cupid in early modern literature and culture। Cambridge University Press। আইএসবিএন 978-0-521-76761-3। সংগ্রহের তারিখ ২০ নভেম্বর ২০২২ 
  5. Templeton, Sir John (১৯৯৯)। Agape Love: Tradition In Eight World Religions। Templeton Foundation Press। পৃষ্ঠা 49। আইএসবিএন 978-1-890151-75-1 
  6. Carroll, p. 31
  7. Luce Irigaray, Sharing the World (2008) p. 49 and p. 36
  8. Quoted in E. Conze, Buddhist Scriptures (1973) p. 178
  9. Hindu Philosophy of Marriage[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  10. F. Yang/J. Taamney, Confucianism (2011) p. 289
  11. Vivekananda, Swami (সেপ্টেম্বর ১০, ২০১০)। The God Of Love Is His Own Proof (English ভাষায়)। Kessinger Publishing, LLC। আইএসবিএন 978-1163062906 
  12. Anonymous (মে ৩০, ১৯৭৩)। The Dhammapada: The Path of Perfection। Mascaró, Juan কর্তৃক অনূদিত। Penguin Classics। পৃষ্ঠা 76। আইএসবিএন 978-0140442847 
  13. Confucius. (1979). The analects (Lun yü). Harmondsworth ; New York :Penguin Books